009. সূরা আত তাওবাহ্ (Surah At Taubah)

  


সূরা আত তাহরীম (অর্থ,নামকরণ, শানে নুযূল, পটভূমি ও বিষয়বস্তু)


নামকরণ 

সূরার প্রথমে আয়াতের () শব্দ থেকে এর নাম গৃহীত । এটিও সূরার বিষয়-ভিত্তিক শিরোনাম নয় । বরং এ নামের অর্থ হচ্ছে এ সূরার মধ্যে তাহরীম সম্পর্কিত বিষয়ের উল্লেখ আছে ।

নাযিল হওয়ার সময়-কাল 

এ সূরার মধ্যে তাহরীম সম্পর্কিত যে ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে সে সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীসের বর্ণনাসমূহে দু’জন মহিলার কথা উল্লেখ করা হয়েছে । তাঁরা দুজনই নবীর (সা) স্ত্রী । তাঁদের একজন হলেন হযরত সাফিয়া (রা) অন্যজন হযরত মারিয়া কিবতিয়া (রা) । তাদের মধ্যে একজন অর্থাৎ হযরত সাফিয়া (রা) খায়বার বিজয়ের পরে নবীর (সা) সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । আর সর্বসম্মত মতে খায়বার বিজিত হয় ৭ম হিজরীতে । দ্বিতীহ মহিলা হযরত মারিয়াকে (রা) মিসরের শাসক মুকাওকিস ৭ম হিজরী সনে নবীর(সা) খেদমতের জন্য পাঠিয়েছিলেন । ৮ম হিজরীর যুলহাজ্জ মাসে তাঁরই গর্ভে নবীর(সা) পুত্র সন্তান হযরত ইবরাহীম (রা) জন্ম লাভ করেন । এসব ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে এ বিষয়টি প্রায় সুনির্দিষ্ট হয়ে যায় যে, এ সূরাটি ৭ম অথবা ৮ম হিজরীর কোন এক সময় নাযিল হয়েছিল ।

বিষয়বস্তু ও মুল বক্তব্য 

এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূরা । এ সূরার মধ্যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লামের পবিত্র স্ত্রীগণের সাথে জড়িত কিছু ঘটনার প্রতি ইংগিত দিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে ।

একঃ হালাল হারাম এবং জায়েজ নাজায়েযের সীমা নির্ধারণ করার ইখতিয়ার চূড়ান্তভাবে আল্লাহ তা’আলার হাতে । সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা খোদ আল্লাহ তা’আলার নবীর (সা) কাছেও তার কোন অংশ হস্তান্তার করা হয়নি । নবী নবী হিসেবে কোন জিনিসকে হারাম বা হালাল ঘোষণা করতে পারেন কেবল তখনই যখন এ বিষয়ে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে কোন ইংগিত থাকে । সে ইংগিত কুরআন মজীদে নাযিল হয়ে থাক কিংবা তা অপ্রকাশ্য অহীর মাধ্যমে নাযিল হয়ে থাক তাতে কিছু এসে যায় না । কিন্তু খোদ আল্লাহ কর্তৃক মোবাহকৃত কোন জিনিসকে নিজের পক্ষ থেকে হারাম করে নেয়ার অনুমতি কোন নবীকেও দেয়া হয়নি । এ ক্ষেত্রে অন্য কোন মানুষের তো প্রশ্নই ওঠে না ।

দুইঃ মানব সমাজে নবীর স্থান ও মর্যাদা অত্যন্ত নাজুক । একটি সাধারণ কথা যা অন্য কোন মানুষের জীবনে সংঘটিত হলে তা তেমন কোন গুরুত্বই বহন করে না, কিন্তু অনুরূপ ঘটনাই নবীর জীবনে সংঘটিত হলে আইনের মর্যাদা লাভ করে । তাই আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে অত্যন্ত কঠোরভাবে নবী-রসূলদের জীবন পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যাতে তাদের অতি ক্ষুদ্র কোন পদক্ষেপও আল্লাহর ইচ্ছার পরিপন্থি না হয় । নবীর দ্বারা এমন কোন ক্ষুদ্র কাজও সংঘটিত হয়ে গেলে সংগে সংগে তা সংশোধন করে দেয়া হয়েছে, যাতে ইসলামী আইন ও তার উৎস সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ রূপে শুধু আল্লাহর কিতাব আকারে নয় বরং নবীর “উসওয়ায়ে হাসানা” বা উত্তম জীবন আদর্শরূপে আল্লাহর বান্দাদের কাছে পৌছে এবং তার মধ্যে অণু পরিমাণও এমন কোন জিনিস সংমিশ্রিত হতে না পারে, আল্লাহর ইচ্ছা ও মর্জির সাথে যার কোন মিল নেই ।

তিনঃ ওপরে বর্ণিত মূলনীতির আলোকে আপনা থেকেই যে বিষয়টি বুঝা যায় তা এই যে, একটি ক্ষুদ্র বিষয়েও যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভুল দেখিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তা শুধু সংশোধনই করা হয়নি, বরং রেকর্ডভুক্তও করা হয়েছে তখন তা অকাট্যভাবে আমাদের মনে এ আস্থা সৃষ্টি করে যে, নবীর (সা) পবিত্র জীবনকালে যেসব কাজকর্ম ও হুকুম -আহকাম বর্তমানে আমরা পাচ্ছি, এবং যেসব কাজকর্ম ও হুকুম আহকাম সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে কোন তিরস্কার ব সংশোধনী রেকর্ডে নেই তা পুরোপুরি সত্য ও নির্ভুল এবং আল্লাহর ইচ্ছার সাথে সম্পূর্ণরূপে সংগতিপূর্ণ । ঐ সব কাজকর্ম ও আদেশ নিষেধ থেকে আমরা পূর্ণ আস্থার সাথে হিদায়াত ও পথনির্দেশ গ্রহণ করতে পারি ।

কুরআন মজীদের এই বাণী থেকে চতুর্থ যে বিষয়টি সামনে আসে তা হচ্ছে, যে পবিত্র রসূলের সম্মান ও মর্যাদাকে আল্লাহ নিজে বান্দাদের ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংগ হিসেবে গণ্য করেন সেই রসূল সম্পর্কে এ সূরাতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তিনি তাঁর স্ত্রীদের খুশী করার জন্য একবার আল্লাহর হালালকৃত একটি জিনিসকে নিজের জন্য হারাম করে নিয়েছিলেন । আর নবীর (সা) পবিত্র স্ত্রীগণ, আল্লাহ নিজে যাদেরকে ঈমানদারদের মা বলে ঘোষণা করেন এবং যাঁদেরকে সম্মান করার জন্য তিনি নিজে মুসলমানদের নির্দেশ দিয়েছেন কিছু ভুল -ত্রুটির জন্য তাদেরকেই আবার তিনি কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন । তাছাড়া নবীকে তিরস্কার এবং তার স্ত্রীদেরকে সাবধান চুপিসারে করা হয়নি, বরং তা সেই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে যা সমস্ত উম্মাতকে চিরদিন পড়তে হবে । আল্লাহ তা’আলা তার রসূল এবং উম্মুল মু’মিনীনদেরকে ঈমানদারদের দৃষ্টিতে হেয়প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে তাঁর কিতাবে এসব উল্লেখ করেননি । আল্লাহ তা’আলার এরূপ কোন অভিপ্রায় ছিল না , কিংবা তা থাকতেও পারে না । একথা স্পষ্ট যে, পবিত্র কুরআনের এ সূরা পাঠ করে কোন মুসলমানের অন্তর থেকে তাদের সম্মান ও মর্যাদা উঠে যায়নি । তাহলে কুরআনে এ কথা উল্লেখ করার উদ্দেশ্য এ ছাড়া আর কি হতে পারে যে, আল্লাহ তা’আলা ঈমানদারদেরকে তাদের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে সম্মান প্রদর্শনের সঠিক সীমারেখার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চান । নবীগণ কেবল নবীই, তাঁরা খোদা নন যে, তাদের কোন ভুল -ত্রুটি হতে পারে না । বরং নবীর মর্যাদা এ কারণে যে, তিনি আল্লাহর ইচ্ছার পূর্ণাঙ্গ বাস্তব রূপ । তাঁর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভুল -ত্রুটিকেও আল্লাহ সংশোধন না করে ছেড়ে দেননি । এভাবে আমরা এ আস্থা ও প্রশান্তি লাভ করি যে, নবীর রেখে যাওয়া আদর্শ আল্লাহর ইচ্ছার বাস্তব প্রতিনিধিত্ব করছে । একইভাবে সাহাবা কিরাম হোন বা নবীর (সা) পবিত্র স্ত্রীগণ হোন, তাঁরা সবাই মানুষ ছিলেন, ফেরেশতা বা মানব সত্তার উর্ধে ছিলেন না । তাদেরও ভুল-ত্রুটি হওয়া সম্ভব ছিল । তাঁরা যে মর্যাদা লাভ করেছিলেন তার কারণ ছিল এই যে, আল্লাহর রসূলের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ তাদেরকে মানবতার সর্বোত্তম নমুনা বানিয়ে দিয়েছিল । তাদের যা কিছু সম্মান ও মর্যাদা তা এ কারণেই । তাঁরা ভুল-ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন এরূপ অনুমান ও মনগড়া ধারণার ওপর তাদের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত নয় । এ কারণেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কল্যাণময় যুগে সাহাবা কিরাম কিংবা নবীর (সা) পবিত্র স্ত্রীগণের দ্বারা মানবিক দুর্বলতার কারণে যখনই কোন ভুল-ত্রুটি সংঘটিত হয়েছে তখনই তাদের সতর্ক করা হয়েছে ও ভুল -ত্রুটি ধরিয়ে দেয়া হয়েছে । নবী (সা) নিজেও তাদের কিছু কিছু ভুল-ত্রুটি সংশোধন করেছেন যা হাদীস গ্রন্থসমূহের বহু সংখ্যক জায়গায় উল্লেখ আছে । আল্লাহ তা’আলা নিজেও কুরআন মজিদে তাদের কিছু কিছু ভুল-ত্রুটির উল্লেখ করে তা সংশোধন করেছেন যাতে মুসলামনগণ কখনেই তাদের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে সম্মান দেখানোর এমন কোন অতিরঞ্জিত ধারণা প্রতিষ্ঠিত করে না নেয় যা তাদেরকে মানুষের পর্যায় থেকে উঠেয়ে আল্লাহর মর্যাদার বসিয়ে না দেয় । আপনি যদি চোখ খুলে কুরআম মজীদ অধ্যয়ন করেন তাহলে আপনার সামনে এর দৃষ্টান্ত একের পর এক আসতে থাকবে । আল্লাহ তা’আলা সূরা আলে ইমরানে ওহুদ যুদ্ধের আলোচনা প্রসংগে সাহাবা কিরামদের সম্বোধন করে বলেছেনঃ

“আল্লাহ তা’আলা (সাহায্য -সহযোগিতার ) যে প্রতিশ্রুতি তোমাদের দিয়েছিলেন তা তিনি পূরণ করেছেন যখন তোমরা তাদেরকে তাঁর ইচ্ছায় হত্যা করছিল । অবশেষে তোমরা যখন দুর্বলতা দেখালে এবং কাজের ব্যাপারে মতানৈক্য করলে আর যে জিনিসের আকাংখা তোমরা করছিলে আল্লাহ তা’আলা যেই মাত্র তোমাদের সেই জিনিস দেখালেন (অর্থাৎ গণিমতের সম্পদ) তখনই তোমরা তার হুকুমের নাফরমানি করে বসলে । তোমাদের মধ্যে কেউ ছিল পার্থিব স্বার্থের প্রত্যাশী এবং কেউ ছিলে আখেরাতের প্রত্যাশী । এ অবস্থায় তোমাদের পরীক্ষার জন্য আল্লাহ তাদের মোকাবেলায় তোমাদের পরস্ত করে দিলেন । আল্লাহ ঈমানদারদের প্রতি অত্যন্ত সদয়, ও মেহেরবান । “ (আয়াত ১৫২) ।

অনুরূপভাবে সূরা নূরে হযরত আয়েশার বিরুদ্ধে অপবাদের উল্লেখ করে আল্লাহ সাহাবীগণকে বলেনঃ

“এমনটা কেন হলো না যে, যখন তোমরা এ বিষয়টি শুনেছিলে মু’মিন নারী ও পুরুষ সবাই নিজে সে বিষয়ে ভাল ধারণা পোষণ করতে এবং বলে দিতে যে, এটা তো স্পষ্ট অপবাদ । ……… দুনিয়া ও আখেরাতে যদি তোমাদের ওপর আল্লাহর মেহেরবানী ও দয়া না হতো তাহলে যে বিষয়ের মধ্যে তোমরা নিক্ষিপ্ত হয়েছিলে তার পরিণামে কঠিন আযাব তোমাদের গ্রাস করতো । একটু ভেবে দেখ যখন তোমাদের মুখে মুখে কাহিনীটার চর্চা হচ্ছিল এবং তা ছড়াচ্ছিল এবং তোমরা এমন কিছু বলছিলে যে, বিষয়ে তোমাদের কিছুই জানা ছিল না । তোমরা এটাকে একটা মামুলি ব্যাপার মনে করেছিলে । কিন্তু আল্লাহর কাছে তা ছিল গুরুতর বিষয় । কেন তোমরা এ কথা শোনামাত্র বললে না যে, আমাদের জন্য এরূপ কথা মুখে আনাও শোভা পায় না । সুবহানাল্লাহ! এটা তো একটা গুরুতর অপবাদ? আল্লাহ তোমাদের উপদেশ দিচ্ছেন, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক তাহলে ভবিষ্যতে আর কখনো যেন তোমরা এরূপ আচরণ না করো । “ (আয়াত , ১২ থেকে১৭) ।

সূরা আহযাবে নবীর (সা) পবিত্র স্ত্রীগণকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছেঃ

[important]“হে নবী, তোমার স্ত্রীদের বলো, তোমরা দুনিয়া ও তার চাকচিক্য চাও তাহলে এসো আমি তোমাদের কিছু দিয়ে উত্তম রূপে বিদায় করে দিই । আর যদি তোমরা আল্লাহ , তাঁর রসূল এবং আখেরাতের প্রত্যাশী হয়ে থাকো তাহলে জেনে রাখ, তোমাদের মধ্যে যারা সৎকর্মশীল আল্লাহ তাদের জন্য বিরাট পুরস্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন । “ (আয়াত , ২৮ , ২৯) ।[/important]

সূরা জুম’আতে সাহাবীদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

[important]“তারা ব্যবসায়-বাণিজ্য ও খেল -তামাশা দেখে সে দিকে ছুটে গেল এবং (হে নবী ) তোমাকে (খোতবা দানরত অবস্থায়) দণ্ডায়মান রেখে গেল । তাদের বলো, আল্লাহর কাছে যা কিছু আছে তা খেল -তামাশা ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের চেয়ে উত্তম । আল্লাহ সর্বোত্তম রিযিকদাতা । “ (আয়াত ১১) ।[/important]

[pullquote align=”left|center|right” textalign=”left|center|right” width=”30%”][/pullquote]মক্কা বিজয়ের পূর্বে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবী হযরত হাতেব ইবনে আবী বালতায়া নবীর (সা) মক্কা অভিযানের খবর গোপনে কুরাইশদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন । সূরা মুমতাহিনায় তাঁর এ কাজের কঠোর সমালোচনা ও তিরস্কার করা হয়েছে ।

কুরআন মজীদের মধ্যেই এসব উদাহরণ বর্তমান, যে কুরআন মজীদের মধ্যে আল্লাহ তা’আলা সাহাবা কিরাম এবং নবীর (সা) পবিত্র স্ত্রীগণের সম্মান ও মর্যাদা নিজে বর্ণনা করেছেন এবং তাদেরকে রাদিয়াল্লাহ আনহুম ওয়া রাদু আনহু অর্থাৎ তাঁরাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট এবং আল্লাহও তাদের প্রতি সন্তুষ্ট বলে ফরমান শুনিয়েছেন । সম্মানিত ব্যক্তিদের সম্মান দেখানো এই শিক্ষা মধ্যপন্থার ওপর ভিত্তিশীল । এ শিক্ষা মুসলমানদেরকে মানুষ পূজার সেই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করেছে যার মধ্যে ইহুদী ও খৃস্টানরা নিপতিত হয়েছে । আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের বড় বড় মনীষী হাদীস, তাফসীর, এবং ইতিহাস বিষয়ে এসব গ্রন্থ রচনা করেছেন তার মধ্যে যেসব জায়গায় সাহাবায়ে কিরাম, নবীর (সা) পবিত্র স্ত্রীগণ এবং অন্যান্য সম্মানিত ব্যক্তিবর্গদের মর্যাদা ও পূর্ণতার যে বর্ণনা করা হয়েছে সেখানে তাদের দুর্বলতা, বিচ্যুতি এবং ভুল-ত্রুটির ঘটনা বর্ণনা করতেও দ্বিধা করা হয় নাই । অথচ বর্তমান সময়ের সম্মান প্রদর্শনের দাবীদারদের তুলনায় তাঁরা তাঁদের বেশী মর্যাদা দিতেন এবং সম্মান প্রদর্শনের সীমারেখাও তারা এদের চেয়ে বেশী জানতেন ।

পঞ্চম যে কথাটি এ সূরায় খোলাখুলি বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে, আল্লাহর দীন সম্পূর্ণ নিরপক্ষ ও নিখুঁত । এ দীন অনুসারে ঈমান ও আমলের বিচারে প্রত্যেকের যা প্রাপ্য তাই সে পাবে । অতি বড় কোন বোজর্গের সাথে ঘনিষ্ঠতাও তার জন্য আদৌ কল্যাণকর নয় এবং অত্যন্ত খারাপ কোন ব্যক্তির সাথে সম্পর্কও তার কোন ক্ষতি করতে পারে না । এ ব্যাপারে বিশেষ করে নবীর(সা) পবিত্র স্ত্রীগণের সামনে উদাহরণ হিসেবে তিন শ্রেণীর স্ত্রীলোককে পেশ করা হয়েছে । একটি উদাহরণ দেয়া হয়েছে নূহ (আ) ও হযরত লূতের (আ) স্ত্রীদের । তারা যদি ঈমান আনয়ন করত এবং তাদের মহাসম্মানিত স্বামীর সাথে সহযোগিতা করত তাহলে মুসলিম উম্মার মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র স্ত্রীগণের যে মর্যাদা তাদের মর্যাদাও তাই হতো । কিন্তু যেহেতু তারা এর বিপরীত আচরণ ও পন্থা অবলম্বন করেছে তাই নবীদের স্ত্রী হওয়াটাও তাদের কোন কাজে আসেনি এবং তারা জাহান্নামের অধিবাসী হয়েছে । দ্বিতীয় উদাহরণ দেয়া হয়েছে ফেরাউনের স্ত্রীর । যদিও তিনি আল্লাহর জঘণ্য এক দুশমনের স্ত্রী ছিলেন কিন্তু যেহেতু তিনি ঈমান গ্রহণ করেছিলেন এবং ফেরাউনের কওমের কাজ কর্ম থেকে নিজের কাজ কর্মের সম্পূর্ণ আলাদা করে নিয়েছিলেন তাই ফেরাইনের মত চরম পর্যায়ের কাফেরের স্ত্রী হওয়াও তাঁর কোন ক্ষতির কারণ হয়নি । আল্লাহ তা’আলা তাঁকে জান্নাতের উপযুক্ত বানিয়ে দিয়েছেন । তৃতীয় উদাহরণ দেয়া হয়েছে হযরত মারয়াম আলাইহিস সালামের । তাঁর এই বিরাট মর্যাদা লাভের কারণ হলো, আল্লাহ তাআলা তাঁকে যে কঠিন পরীক্ষার মধ্যে নিক্ষেপ করার ফায়সালা করেছিলেন তা তিনি মাথা পেতে গ্রহণ করেছেন । তাঁকে কুমারী অবস্থায় আল্লাহর হুকুমে মু’জিযা হিসেবে গর্ভবতী বানিয়ে দেয়া হয়েছে এবং এভাবে তাঁর রব তাঁর দ্বারা কি কাজ নিতে চান তাও তাকে বলে দেয়া হয়েছে । হযরত মারয়াম ছাড়া পৃথিবীর আর কোন অভিজাত ও নেককার মহিলাকে এরূপ কোন কঠিন পরীক্ষার মধ্যে কখনো ফেলা হয়নি । হযরত মারয়াম এ ব্যাপারে যখন কোন আফসোসও আর্তনাদ করেননি বরং একজন খাঁটি ঈমানদার নারী হিসেবে আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা পূরণ করার জন্য যা বরদাশত করা অপরিহার্য ছিল তা সবই বরদাশত করা স্বীকার করেছেন তখন আল্লাহ তা’আলা তাঁকে () ‘বেহেশতের মহিলাদের নেত্রী’(মুসনাদে আহমাদ) হওয়ার মত সুউচ্চ মর্যাদা দান করেছেন ।

এসব বিষয় ছাড়াও আমরা আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য এ সূরা থেকে জানতে পারি । তা হচ্ছে, কুরআন মজীদে যা কিছু লিপিবদ্ধ আছে আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কেবল সেই জ্ঞানই আসতো না । বরং তাঁকে অহীর মাধ্যমে অন্যান্য বিষয়ের জ্ঞানও দেয়া হতো যা কুরআনে লিপিবদ্ধ করা হয়নি । এ সূরার ৩নং আয়াত তার সুস্পষ্ট প্রমাণ । তাতে বলা হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পবিত্র স্ত্রীদের একজনের কাছে গোপনীয় একটি কথা বলেছিলেন । কিন্তু তিনি তা অন্য কাউকে বলেছিলেন । আল্লাহ তা’আলা বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানিয়ে দিলেন । অতপর নবী (সা) এই ত্রুটির জন্য তাঁর সেই স্ত্রীকে সতর্ক করে দিলেন । এতে তাঁর স্ত্রী তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন যে, তাঁর এই ত্রুটি সম্পর্কে তাঁকে কে অবহিত করেছেন । নবী (সা) জবাব দিলেন । যে সত্তা আলীম ও খাবীর তিনিই আমাকে তা জানিয়েছেন । এখন প্রশ্ন হচ্ছে, গোটা কুরআন মজীদের মধ্যে সেই আয়াতটি কোথায় যার মধ্যে আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীকে গোপনীয় যে কথা বলেছিলে তা সে অন্যের কাছে বা অমুকের কাছে প্রকাশ করে দিয়েছে? কুরআনে যদি এমন কোন আয়াত না থেকে থাকে এবং এটা সুস্পষ্ট যে, তা নেই তাহলে এটাই এ বিষয়ের সুস্পস্ট প্রমাণ যে, কুরআন ছাড়াও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অন্য অহী আসতো । কুরআন ছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আর কোন অহী আসতো না, হাদীস অস্বীকারকারীদের এ দাবী এর দ্বারা বাতিল হয়ে যায় ।


Post a Comment

0 Comments