সাইয়েদ কুতুব শহীদ একটি মহাজীবন



     নীলনদের দেশ মিসর, পিরামিডের দেশ মিসর, ফেরাউনের দেশ মিসর, মুসা (আ.) এর দেশ মিসর, জামাল আব্দুন নাসেরের দেশ মিসর, হাসানুল বান্নাহর দেশও মিসর। সেই মিসরেই সাইয়েদ কুতুবের জন্ম। ১৯০৬ সালে মিসরের ‘উসয়ূত’ জেলার ‘মুশা’ গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সাইয়েদ তাঁর নাম। কুতুব তাঁদের বংশীয় উপাধি। কুতুব পরিবার ছিল খুবই দ্বীনদার পরিবার। এ পরিবারের পিতা হাজী ইবরাহীম কুতুব ও মাতা ফাতেমা হুসাইন ওসমানের øেহপরশে সাইয়েদ লালিত-পালিত হন।

সাইয়েদ কুতুবের পিতা কৃষিকর্ম করতেন। তিনি ছিলেন আল্লাহ্ভীরু ও চরিত্রবান। মসজিদে জামায়াতের সাথে নামায আদায়ে অভ্যস্ত ছিলেন। সাইয়েদ কুতুবের চরিত্র গঠনে এবং পরিবারের ইসলামী তাহযীব সংরক্ষণে হাজী ইবরাহীম কুতুব খুবই সচেতন ছিলেন। তিনি যখন নামায আদায়ের জন্য মসজিদে যেতেন, সাইয়েদকেও সাথে নিতেন। ইসলামের মৌলিক বিষয় শিক্ষা দিতেন। এভাবে শিশু বয়সেই ইসলামের প্রতি তাঁর ভালবাসা জন্মে।
সাইয়েদের পিতা দান-খয়রাত করতে ভালবাসতেন। গরীব-মিসকীন যারাই তাঁর বাড়ি যেতেন সকলকে খেতে দিতেন। চাষাবাদ করতে অনেক কাজের লোকের প্রয়োজন হত, তিনি তাদেরও আত্মমর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। অন্যান্য ভূস্বামীগণ যে পরিমাণ মজুরী দিতেন, তিনি তার চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক দান করতেন। তিনি তাদের তাই খেতে দিতেন, যা তাঁরা নিজেরা খেতেন। তাঁর বাড়িতে প্রতি বছর বিভিন্ন অনুষ্ঠান হত। দুই ঈদ, আশুরা, মিরাজসহ বিভিন্ন দিবসে কারীগণ সমবেত হয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। রমযান মাসে কুরআন খতম অনুষ্ঠান হত।
সাইয়েদের মাতাও ছিলেন খুবই দ্বীনদার। তিনিও দান-খয়রাত করতে পছন্দ করতেন। তিনি কুরআনের তিলাওয়াত শুনতে ভালবাসতেন। যারা কুরআনের তিলাওয়াত শোনাতো তাদের নিজের হাতে রান্না করা খাবার খেতে দিতেন। তিনি পর্দার আড়াল থেকে কুরআনের তিলাওয়াত শোনার সময় সাইয়েদকে কোলে রাখতেন। মায়ের কোলে থাকার সময় মা কুরআন মুখস্থ করতেন এবং সাইয়েদকেও শিখাতেন।
সাইয়েদ কুতুবের পিতা দুটি বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রীর ঘরে এক সন্তান জন্মগ্রহণ করে। দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন সাইয়েদ কুতুবের মা। সাইয়েদ কুতুবরা ছিলেন পাঁচ ভাই-বোন। সাইয়েদ কুতুব, আমিনা কুতুব, মুহাম্মদ কুতুব, হামিদা কুতুব এবং নাফীসা কুতুব। সাইয়েদ কুতুব সবার বড়। তাঁর সৎ বোনের নাম জানা যায়নি। সাইয়েদ সবাইকে খুবই আদর করতেন। ভাই-বোন সকলেই আল্লাহ্র রাহে চলার ক্ষেত্রে একই সূত্রে গাঁথা ছিলেন।
‘মুশা’ গ্রামে সাইয়েদের বাল্য জীবন: সাইয়েদ কুতুব মিসরের ‘উসয়ূত’ জেলার ‘মুশা’ গ্রামের ছায়াসুনিবিড় মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় হন। পনের বছর পর্যন্ত গ্রামেই কাটান। গ্রামটি ছিল খুবই মনমুগ্ধকর। দু’টি পাহাড়ে ঘেরা। ফসলের বিস্তীর্ণ মাঠ। সবুজ-শ্যামল গাছ-গাছালীতে সুশোভিত। গ্রামের একপাশের প্রবাহমান নীলনদ গ্রামের শোভা বর্ধন করেছে। গ্রামবাসীরা চাষাবাদ করতেন। ফসল কাটার সময় ছোট-বড় সকলকেই মাঠে কাজ করতে হত। নীলনদের পানি বৃদ্ধি পেলে গ্রামবাসীরা ছোট ছোট যন্ত্রচালিত যান বা নৌকায় একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করতো। বাল্যকালে পানির ঢেউয়ের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে সাইয়েদ আনন্দ পেতেন। তাঁর কাছে খুবই ভাল লাগতো যখন তিনি দেখতেন তাঁর মাদ্রাসা ছোট উপদ্বীপের মতো তিন দিক থেকে পানিবেষ্টিত। গ্রামের লোকজন একদিক দিয়ে মাদ্রাসায় যেতে পারতো। মাদ্রাসা ঘরটি সবুজ গাছে ঘেরা ছিল। ফুলের বাগান ছিল মাদ্রাসার সামনে। ফল-ফুলের সৌরভে মোহিত হতো চারিদিক। সাইয়েদের বাসগৃহের চতুর্দিক নানাবিধ বাহারী রঙের ফুলে সুশোভিত ছিল। দু’টি খেজুর গাছ ছিল ঘরের সামনে। বাতাসে গাছের পাতা নড়াচড়া করতো, সাইয়েদ তা দেখে মনে মনে পুলকিত বোধ করতেন।।
গ্রামের লোকজন কুঁড়েঘর, একতলা ও দো’তলা ঘরে বসবাস করত। গরীব লোকজন অন্যের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। তাদের সাথে সাইয়েদের বন্ধতত্ত্ব ছিল। তিনি তাঁর পিতার সাথে গরীব মানুষদের খোঁজ-খবর নিতেন। অসহায়দের নিজ বাড়িতে এনে খাবারের ব্যবস্থা করতেন। নিজ ঘর থেকে খাদ্যদ্রব্য নিয়ে গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। তিনি গ্রামের সকলের সাথে মিশতেন। তাঁর মনে অহংকার ছিল না।
কিশোর সাইয়েদের পড়াশোনা: মায়ের কোলেই সাইয়েদের পড়াশোনা শুরু হয়। তিনি ছিলেন খুবই মেধাবী। তাঁর স্মরণশক্তি ছিল খুবই প্রখর। মায়ের আগ্রহে গ্রামের মকতবে কুরআন হিফয করেন। সে সময় মিসরের দ্বীনদার পরিবারে কুরআন হিফযের ঐতিহ্য ছিল। বিশেষতঃ যারা আল-আযহারে তাদের সন্তানদের পড়াশোনায় আগ্রহী ছিল, তাদের সন্তানদের কুরআন হিফয বলতে কিছু বাধ্যতামূলক ছিল। সাইয়েদ প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ১৯১২ সালে মাদ্রাসা-ই তাজহিযিয়াতে ভর্তি হন।
মাদ্রাসায় ভর্তির পর প্রথম দিনই একটা ঘটনা ঘটে। তিনি মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে আসেন। মাদ্রাসার একজন শিক্ষক তা দেখে ফেলেন। ছাত্রদের নিকট ঘটনা প্রচার করা হয়। এজন্য সাইয়েদকে ভর্ৎসনা করা হয়। এ ঘটনার পর সাইয়েদ মাদ্রাসায় যাওয়া বন্ধ করে দেন। তিনি ভাই-বোনদের সাথে খেলাধুলা করতেন। প্রাতিষ্ঠানিক শাসনের চেয়ে পারিবারিক øেহ-মমতায় তিনি পড়াশোনার প্রতি অধিক মনোযোগী হন। পরে সবাই তাঁকে বুঝিয়ে আবার মাদ্রাসায় পাঠালে মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক এবার তাঁকে বিশেষ তত্ত্বাবধানে রাখেন। তাঁর বিরল প্রতিভা দেখে প্রধান শিক্ষক আশান্বিত হন যে, একদিন এ কিশোর অনেক বড় কিছু হবে।
কিশোর সাইয়েদের ক্ষুদে পাঠাগার: কিশোর সাইয়েদ শুধু পাঠ্য পুস্তক পড়তেন না। কচি বয়সেই পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও অন্যান্য আকর্ষণীয় বই পড়ার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। কোনো বই তাঁর পছন্দ হলে আব্বার কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিতেন এবং নতুন বই কিনতেন। শিশু বয়সেই তিনি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি তাঁর কেনা বই পাড়ার ছেলেদের পড়তে দিতেন। তাঁর ক্ষুদে পাঠাগারে পঁচিশটির মতো বই ছিল। গল্প, উপন্যাস, ধর্মীয় সকল ধরনের বই-পুস্তক তিনি সংগ্রহ করতেন। গ্রামের নারী-পুরুষ অনেককে বই পড়ে শোনাতেন।
বড়দের সাথে কিশোর সাইয়েদ: সাইয়েদ যে মসজিদে নামায পড়তেন সেখানে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতরা দারস দিতেন। নাহু, সরফ, বালাগাতের উপর আলোচনা করতেন। শ্রোতাদের মধ্যে অনেকেই সকল কিছু সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারতেন না। আশ্চর্যের কথা, শিশু সাইয়েদ এ ধরনের দারসেও বসতেন। জ্ঞানের পিপাসা তাঁর এত বেশি ছিল যে, তিনি জানার জন্য পণ্ডিতদের কাছে অনেক প্রশ্নও করতেন। ফলে কিশোর সাইয়েদের প্রতি পণ্ডিতদের সুদৃষ্টি পড়ে। তাঁরা তাঁকে খুবই আদর করতেন। বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে আরবী ভাষা শিখান। এভাবে বাল্যকালেই তিনি আরবী নাহু, সরফ ও বালাগাতে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।
একসাথে পড়ছেন অথচ সাইয়েদ ব্যতিক্রম চরিত্রের: সাইয়েদ কুতুব যে প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করেছেন সেখানে আগে সহশিক্ষা চালু ছিল না। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সহশিক্ষা চালু হয়। এরপর সাইয়েদের সাথে সাত জন ছাত্রী ভর্তি হয়। তাদের বয়স দশ বছরের বেশি ছিল না। ছাত্রীদের আগমনের পর বখাটে ছেলেরা তাদের আজেবাজে অনেক কথা বলতো। সাইয়েদ ছিলেন এসব থেকে মুক্ত। তিনি ছিলেন লাজুক। ছাত্রীদের যারা নানা কথা বলতো তিনি তাদের ভর্ৎসনা করতেন। ছাত্রীদের সম্মান রক্ষায় তিনি এগিয়ে আসতেন। ফলে ছাত্রীরা তাকে ভাল জানতেন। একদিন তিনি ঘরে বসে পড়ছেন। হঠাৎ দরজায় নক হলো। দরজা খুলতেই সেই কয়েকজন তরুণীকে দেখতে পান। তারা জানায়, আমরা আপনার ছোট বোনের সাথে খেলতে এসেছি।
জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ: ১৯১৮ সালে সাইয়েদ মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর দু’বছর পড়া বন্ধ থাকে। সাইয়েদের পিতা ছিলেন রাজনীতি সচেতন। তিনি জাতীয় আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাদের ঘরে ছোট-বড় অনেকেই উপস্থিত হতো। গোপন মিটিং হত। সভা অনুষ্ঠিত হত। পত্রিকা পাঠের জন্য গ্রামবাসীরা ভিড় করতো। ইবরাহীম কুতুব নিজে পত্রিকা পাঠ করে শোনাতেন। কখনও কখনও কিশোর সাইয়েদ পিতার পরিবর্তে নিজে পত্রিকা পাঠ করতেন। উপস্থিত সকলেই শুনতো। সাইয়েদ কুতুব পড়াশুনার পাশাপাশি রাজনৈতিক দীক্ষাও পিতার কাছ থেকে বাল্য বয়সেই লাভ করেন।
সাইয়েদের উচ্চ শিক্ষা: ১৯২০ সালে সাইয়েদ কায়রো যান। তিনি তার খালু আহমদ হোসাইন ওসমানের বাসায় ওঠেন। তিনি ‘আহমদ আল মুশা’ নামে পত্রিকায় লিখতেন। কায়রোর ‘আয যায়তুন’ এলাকায় বাস করতেন। খালুর বাসায় এক বছর কাটিয়ে মাদ্রাসা-ই আব্দুল আযীযে ভর্তি হন। তিন বছরের শিক্ষা কোর্স ১৯২৪ সালে শেষ করেন। ১৯২৫ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা আত তাজহিযিয়ায় ভর্তি হন। চার বছরের এ শিক্ষা কোর্স ১৯২৯ সালে সমাপ্ত হয়। এখানে আরবী ভাষা, ফিক্হ, ইসলামী শিক্ষা, কুরআন, হাদীস, তাফসীর, ভূগোল, ইতিহাস, জীববিদ্যা, রাষ্ট্রনীতি, অংক প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। ১৯২৯ সালের শেষ দিকে দারুল উলুম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। চার বছর এখানে কাটান। ১৯৩৩ সালে তিনি আরবী ভাষা ও সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করেন।
সাইয়েদ কুতুব সাধারণ ছাত্রদের মতো ছিলেন না। তিনি প্রতিষ্ঠানে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। কখনও কখনও শিক্ষকদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বিভিন্ন বিষয়ে নিজস্ব মতামত পেশ করতেন।
প্রাক্তন ছাত্রদের সমিতি গঠন ও পত্রিকা প্রকাশ: সাইয়েদ কুতুব ‘দারুল উলুম বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে পড়াশুনা শেষে আরবী ভাষা ও সাহিত্যে উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে ১৯৩৩ সালে দারুল উলুমের প্রাক্তন ছাত্রদের নিয়ে একটি সংগঠন করেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মধ্যে ছিলেন মুহাম্মদ ইবরাহীম, ফায়েদ আল আমরুচী, সা‘দ লুবনান প্রমুখ। তাঁরা ‘দারুল উলুম সাময়িক’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। বছরে চারটি সংখ্যা প্রকাশিত হত। ১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহতভাবে ১৪ বছর এ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এতে সাহিত্য ও সমালোচনামূলক তাঁর অনেক লেখা প্রকাশিত হয়।
পত্রিকা ও সাময়িকীতে লেখালেখি: ছোটবেলা থেকেই সাইয়েদের লেখালেখির অভ্যাস ছিল। ১৯২২ সালে দৈনিক ‘আল-বালাগ’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল ষোল বছর। তিনি বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে গদ্য, পদ্য, প্রবন্ধ, সাহিত্য সমালোচনা, শিক্ষা, সমাজ, রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে লিখতেন। অল্প দিনের মধ্যে তাঁর লেখালেখির খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি অধ্যাপনা, মন্ত্রণালয়ের চাকরি, সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চা একসাথেই চালিয়ে যান। তিনি ‘আল আহরাম’ পত্রিকার বেতনভুক্ত স্টাফ ছিলেন। এ পত্রিকার সাহিত্য পাতায় নিয়মিত লিখতেন। ১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ত্রৈমাসিক দারুল উলুম পত্রিকায় গবেষণাধর্মী লেখালেখি করেন। সে সময় প্রকাশিত প্রায় সকল পত্রিকায়ই তাঁর লেখা ছাপা হত। তাঁর প্রবন্ধ ও কবিতার সংখ্যা ৪৫৫। একবার তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, প্রাতিষ্ঠানিক চাকুরী ও সাংবাদিকতার মধ্যে কোন্টিকে আপনি গুরুত্ব দিচ্ছেন? তিনি জবাব দেন, সাংবাদিকতা ও মাদ্রাসা দু’টির মাঝেই আমি বড় হয়েছি। দু’টির মাঝে আমি বেঁচে আছি। দু’টিকেই আমি সমভাবে ভালবাসি। দু’টির মাঝে আমি হৃদয়ের খোরাক পাই। আমি এ দু’টির মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করতে চাই না।
জীবনের শুরুতে তিনি সাহিত্য সমালোচনামূলক লেখালেখিই বেশি করেছেন। ইসলামের দাওয়াত ও জিহাদের কাজে অংশগ্রহণ করার পর লেখালেখির ক্ষেত্র সংকুচিত হয়। অনেক পত্রিকার দর্শনের সাথে তাঁর চিন্তা-চেতনার মিল ছিল না, তাই সেই সকল পত্রিকায় লেখালেখি বন্ধ হয়ে যায়।
সাহিত্য ও পন্ডিতদের সাথে সাইয়েদের সম্পর্ক: মিসরের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও পণ্ডিতদের সাথে সাইয়েদের গভীর সম্পর্ক ছিল। বাল্যকাল থেকেই তিনি বিভিন্ন সাহিত্য সভায় অংশগ্রহণ করতেন। এভাবেই সাহিত্যিকদের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। সাহিত্য রচনা ও সাহিত্য সমালোচনা করতে গিয়ে সাহিত্যিকদের সাথে তাঁর গভীর হৃদ্যতা সৃষ্টি হয়। তিনি কবি হুসাইন শফিক আল মিসরী ও আহমদ মুখাইসের সাথে কবিতা পাঠের অনেক আসরে যোগ দেন। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম খ্যাতিমান সাহিত্যিক ড. তোহা হোসাইনের সাথে তাঁর হৃদ্যতার কথা সবারই জানা। তাওফিক হাকিম আরবী সাহিত্যের এক উজ্জ্বল প্রতিভা। তাঁর সাথে সাইয়েদের সাহিত্য দর্শনের মিল ছিল না, তবু তিনি সাইয়েদকে খুবই আদর করতেন।
তাওফিক হাকিম তার একটি গ্রন্থ সাইয়েদকে উৎসর্গ করেন। সাইয়েদও তাঁর সাহিত্য প্রতিভার ভূয়সী প্রশংসা করে চিঠি লেখেন। সাইয়েদের সাথে আব্বাস মাহমুদ আল আক্কাদেরও গভীর সম্পর্ক ছিল। তিনি সাহিত্য চর্চায় আব্বাস আল আক্কাদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। আল আক্কাদ সাহিত্যের ক্লাস নিতেন। সাইয়েদ তাতে অংশগ্রহণ করতেন। সাইয়েদের অনন্য প্রতিভার জন্য আল আক্কাদ তাঁকে খুবই øেহ করতেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চাকুরী ও আমেরিকা গমন: সাইয়েদ কুতুব ১৯৩৩ সালে শিক্ষক হিসেবে চাকুরী জীবন শুরু করেন। ১৯৪০ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। সেখানে আরবী সংস্কৃতি বিভাগ দেখাশোনা করতেন। অতঃপর অনুবাদ বিভাগে বদলী হন। ১৯৪৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইন্সপেক্টরের দায়িত্ব পান। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়। কিছুদিন যাওয়ার পর ১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসে সাংস্কৃতিক দফতরে বদলী হন। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত এখানে কর্মরত ছিলেন। ১৯৪৮ সালের ৩ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমেরিকা গমন করেন।
জাহাজে রোমাঞ্চকর ঘটনা: সাইয়েদ কুতুব সমুদ্রপথে আমেরিকা যাচ্ছেন। সাগরে ঢেউয়ের তালে তালে জাহাজ চলছে। অথৈ পানির মাঝে চাঁদের কিরণ। কী চমৎকার লাগছে! জাহাজ সমুদ্রে সাঁতার কেটে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। সাইয়েদ তন্ময় হয়ে ভাবছেন আল্লাহ্র সৃষ্টি নিয়ে। নিজকে নিজে বলছেন, আমি কি সেই আমেরিকা যাচ্ছি, যারা খাওয়া ও ঘুমকেই যথেষ্ট মনে করে! যারা ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকে! বৈধ-অবৈধের কোন সীমারেখা নেই যাদের জীবনে!
তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, আমেরিকায় গিয়ে ইসলামের উপর অবিচল থাকবেন। দাওয়াতের কাজ করবেন। মনে মনে ভাবলেন, আমি এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হচ্ছি। আমি কি আমার দর্শনে সত্যবাদী, না এটা মনের কল্পনা, তা
বাস্তবে পরীক্ষা হবে।
আল্লাহ্র এই বান্দাহ জাহাজেই পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন। জাহাজেই এক রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটলো। সাইয়েদ কুতুব তাঁর কক্ষে। বাইর থেকে কে যেন দরজায় নক করছে। তিনি দরজা খুলে চমকে উঠলেন। এক সুন্দরী রূপসী সুঠামদেহী নগ্নপ্রায় যুবতী তাঁর সামনে দণ্ডায়মান। পুরো শরীরে রূপ যেন উপচে পড়ছে। তিনি সাইয়েদ কুতুবকে বললেন জনাব, আমি কি আজ রাত আপনার রুমে আপনার মেহমান হতে পারি? সাইয়েদ কুতুব জবাব দিলেন, দুঃখিত! রুমে একটি খাট। এক খাট একজনের জন্য নির্ধারিত। যুবতী বললো, খাট এত প্রশস্ত যে, এতে দু’জনও থাকা যায়। যুবতী ঘরে প্রবেশের চেষ্টা করলো। সাইয়েদকে তার প্রতি আকৃষ্ট করার নানা কৌশল প্রয়োগ করলো। কিন্তু আল্লাহ্র ভয়ে ভীত সাইয়েদের মন যুবতীর দিকে যায়নি। তিনি দরজা বন্ধ করে দিলেন। মেয়েটি দীর্ঘক্ষণ দরজার বাইরে খটখট করে চলে গেল। প্রবৃত্তির উপর নৈতিকতার জয় হলো।
জাহাজে আরেক ঘটনা ঘটলো। একজন খ্রিস্টানকে মুসলমানদের মাঝে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করতে দেখে সাইয়েদের মাঝে ঈমানী চেতনা জাগ্রত হলো। তিনি কাপ্তানের কাছে গেলেন। জাহাজে আরোহী সকল মুসলমানের জুমার নামায আদায়ের সুযোগদানের জন্য আবেদন করলেন। কাপ্তান সম্মত হলো।
সাইয়েদ জুমার পূর্বে চমৎকার খুতবা দিলেন। নামাযে ইমামতি করলেন। আরোহীরা বিমোহিত চিত্তে তাকিয়ে রইলো। যুগোশ্লাভিয়ার জনৈকা খ্রিস্টান মহিলা কুরআন তিলাওয়াত শুনে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হলেন।
আমেরিকায় দুই বছর: সাইয়েদ দুই বছর আমেরিকায় অবস্থান করেন। সেখানে অনেক অনৈতিক ও অশালীন ঘটনা প্রতক্ষ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের নগ্নতা দেখে ভাবলেন, তারা প্রবৃত্তির দাস হয়ে কতই না অধঃপতিত জীবন যাপন করছে! হাসপাতালে মহিলা রোগীকেও যৌন অত্যাচারের শিকার হতে দেখলেন। সমমৈথুনে লিপ্ত হচ্ছে নর-নারী। তাঁরও পদস্খলন ঘটাতে চেষ্টার কমতি ছিল না। আল্লাহ্র অসীম রহমতে তিনি ইসলামের উপর অবিচল থাকতে পেরেছেন।
সাইয়েদ আমেরিকা থাকার সময় পশ্চিমা সভ্যতার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হন। তিনি আগের তুলনায় ইসলামের প্রতি আরও অধিক অনুরাগী হন। দু’বছর পর আমেরিকা থেকে ফিরেই তিনি ইসলাম সম্পর্কে নতুন জ্ঞান লাভ করেন। তাঁর নিকট দ্বীন ইসলামের প্রকৃত তত্ত্ব উদ্ভাসিত হয়। ইসলাম যে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে এক বিরাট নিয়ামত এবং আধুনিক জাহেলিয়াতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইসলামের কোন বিকল্প নেই, এ কথা তিনি দৃঢ়ভাবে উপলব্ধি করেন। মনে মনে ভাবলেন, অতীতে রঙিন স্বপ্ন ও নানা কল্পনা আমাকে প্রতারিত করেছে। তিনি ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করেন এবং কুরআনের ছায়াতলে জীবন যাপন শুরু করলেন। তারপর চাকুরী থেকে ইস্তিফা দানের সিদ্ধান্ত নিলেন।
চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ: সাইয়েদ কুতুব মন্ত্রণালয়ের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিকট প্রিয় ছিলেন। তাঁর অনুপম চারিত্রিক মাধুর্যে সবাই মুগ্ধ ছিল। আমেরিকা থাকার সময়-ই সাইয়েদের মানসিক পরিবর্তন ঘটে। তিনি আমেরিকা থেকে ফিরে এসেই চাকুরী থেকে ইস্তিফা দেন। ১৯৫২ সালের ১৮ মে ইস্তিফাপত্র জমা দেয়ার সময় শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন ইসমাঈল আলকাবানী। মন্ত্রী মহোদয় পুনরায় চাকুরীতে প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুরোধ জানান। এক বছর পর্যন্ত তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়নি। মন্ত্রীর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর মতপার্থক্য থাকার পরও মন্ত্রী তাঁকে খুবই সম্মান করতেন। কারণ তিনি সব সময় দেশের কল্যাণ নিয়ে চিন্তা করতেন। মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজের মৌলিক পরিকল্পনা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতেন। তিনি চাকুরী জীবনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তুষ্টি বা পদোন্নতির জন্য লালায়িত ছিলেন না। যা সঠিক মনে করতেন তাই বলতেন।
ইখওয়ানুল মুসলিমীনে যোগদান:
সাইয়েদ কুতুব ১৯১৯ সালের জাতীয় আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। ১৭ বছরের অধিক সময় হিযবুল ওয়াফদের সাথে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল। পরবর্তীতে উক্ত সংগঠন ত্যাগ করেন। তাঁর মতে আগামী দিনের সঠিক নেতৃত্বের জন্য নতুন বংশধরদের চরিত্র গঠন প্রয়োজন। এ জাতীয় আন্দোলনে চারিত্রিক সংশোধনের কর্মসূচী নেই। সেহেতু উক্ত সংগঠন ত্যাগের পর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় তিনি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও একাডেমিক ক্ষেত্রে সংশোধনের প্রচেষ্টা চালান। ইখওয়ানে যোগদানের পূর্ব পর্যন্ত ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় দাওয়াত ও ইসলাহের কাজ করেন। ১৯৫২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাকুরী থেকে ইস্তিফা দেয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে ইখওয়ানে যোগ দেন।
তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ইখওয়ানে যোগ দান করার আরো পূর্বে থেকেই ইখওয়ান সম্পর্কে জানতেন। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘স্বাধীন মিসর চাই’ ইখওয়ানের এ শ্লোগান ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। দু’বছরে ইখওয়ানের কর্মীসংখ্যা ২৫ লাখে পৌঁছে। সমর্থক ও সহযোগীদের সংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। সাথে সাথে ষড়যন্ত্র ও নির্যাতন বৃদ্ধি পেতে থাকে।
১৯৪৯ সালের ১২ ফেব্র“য়ারী ইখওয়ানের ‘মুর্শিদে আম’ উস্তাদ হাসানুল বান্নাকে শহীদ করা হয়। ইখওয়ানুল মুসলিমীনকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়। সাইয়েদ কুতুব সেই সময় আমেরিকায় ছিলেন। তিনি হাসানুল বান্নার শাহাদাতের খবর পত্রিকায় পড়ছেন। টপটপ করে অশ্র“ ঝরছে। চোখের পানিতে পত্রিকা ভিজে যায়। সাইয়েদ কুতুব দীর্ঘদিন থেকে সংস্কারবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য একটি যুব সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার কথা চিন্তা করছিলেন। তাঁর স্বপ্নের বাস্তব প্রতিফলন দেখতে পেলেন ইখওয়ানুল মুসলিমীনের মধ্যে। ১৯৪৯ সালেই তিনি তাঁর লিখিত ‘আল আদালাহ্ আল-ইজতিমাইয়াহ্ ফী আল-ইসলাম’ বইটি উপহার দেন সেসব যুবকদের উদ্দেশ্যে, যারা সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রত। এ নজরানার মাধ্যমে ইখওয়ানের প্রতি তাঁর আন্তরিকতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে হাসানুল বান্নার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে কি না তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। হ্যাঁ, তিনি আমেরিকা থেকে ফিরে এসেই ইখওয়ানের ফরম পূরণ করেন। ১৯৫৩ সালে সরকারি চাকুরি থেকে ইস্তিফা দেয়ার আগ পর্যন্ত সরকারি কাজ আনজাম দিয়ে গোপনে ইখওয়ানের কাজে সময় দিতেন।

ইখওয়ানের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সাইয়েদঃ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব
সাইয়েদ ইখওয়ানের একজন সাধারণ সদস্য। তিনি তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করে ইখওয়ানের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। লেখনী, বক্তৃতা, নেতৃত্ব সকল ক্ষেত্রেই তিনি অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেন। ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ইখওয়ানের কেন্দ্রীয় প্রচার ও দাওয়াতী কার্যক্রম বিভাগের ইনচার্জের দায়িত্ব পান।
১৯৫৩ সালে তিনি দামিশ্ক সফর করেন। সেখানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে বক্তৃতা দেন। সাইয়েদ কুতুব দুই ঘণ্টা বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় তিনি কুরআনের সৌন্দর্য, মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেন। তাঁর মনোমুগ্ধকর বক্তৃতা শুনে শ্রোতারা মুগ্ধ হন।
আশ্চর্যের বিষয়, তিনি লিখিত কোন নোট ছাড়াই তথ্যবহুল দীর্ঘ বক্তব্য পেশ করেন।
এরপর তিনি আরেক কনফারেন্সে বায়তুল মোকাদ্দাস যান। সেখান থেকে জর্দান সফর করেন। আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময়ের সময় তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক গঠনমূলক চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সাইয়েদের ভূমিকায় ইখওয়ানের ‘মুর্শিদ-ই-আম’ ওস্তাদ ড. হাসান হুদাইবী মুগ্ধ হয়ে তাঁকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনোনীত করেন। সে সময় ইখওয়ানের পক্ষ থেকে একটি পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সাইয়েদ কুতুবকে পত্রিকার প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি দক্ষতার সাথে পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন।
সাইয়েদ কুতুবের প্রথম কারাবরণ: ১৯৪৫ সালে জামাল আব্দুন নাসের ও ইংরেজদের মধ্যে চুক্তি হয়। ইখওয়ান ‘ইঙ্গ মিসর’ চুক্তির বিরোধিতা করে। ফলে ইখওয়ান কর্মীদের উপর চালানো হয় দমন, পীড়ন ও নির্যাতন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পঞ্চাশ হাজার নেতা-কর্মীকে কারাবন্দী করা হয়। তাঁদের মধ্যে সাইয়েদ কুতুবও ছিলেন। সে সময় তিনি ছিলেন জ্বরে আক্রান্ত। তিনি অসুস্থতায় বিছানায় কাতরাচ্ছিলেন। একজন সামরিক অফিসার ঘরে ঢুকলেন। তার সাথে রয়েছে অনেক সশস্ত্র সিপাহী। তারা রোগশয্যায় শায়িত সাইয়েদ কুতুবের হাতে ঐধহফ ঈঁঢ় পরিয়ে দিলেন। তাঁকে কারাগারের দিকে নিয়ে চললেন। তাঁকে কোন গাড়িতে না চড়িয়ে পায়ে হেঁটে যেতে বাধ্য করা হল। অত্যধিক অসুস্থতার কারণে রাস্তায় চলার পথে তিনি বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়েন। হুঁশ ফিরে এলে মুখে উচ্চারিত হতো ইখওয়ানের প্রিয় সে­াগান ‘আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’
তাঁকে সামরিক কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। কারাগারের ভিতর প্রবেশের সাথে সাথে হিংস্র হায়েনার দল তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দু’ঘণ্টা যাবৎ জেলের অন্ধকার কক্ষে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। তাঁর উপর এক ভয়ংকর কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুরটি সাইয়েদ কুতুবের পায়ে কামড় দিয়ে টেনে হেঁচড়ে এদিক সেদিক নিয়ে যায়। এরপর তাঁকে একটি নির্জন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সাইয়েদ কুতুব নির্যাতনে ক্ষত-বিক্ষত। তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। এমন অবস্থার পরও তাকে রিমান্ডে নিয়ে একের পর এক বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়। দীর্ঘ সাত ঘণ্টা যাবৎ প্রশ্ন পর্বের মাধ্যমে মানসিক নির্যাতন করা হয়।
সাইয়েদ কুতুব শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেও মানসিকভাবে ছিলেন খুবই সবল। ঈমানী বলে তিনি ছিলেন বলীয়ান। কখনো নির্যাতনের সীমা বৃদ্ধি পেলে তিনি মুখে উচ্চারণ করতেন ‘আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ রাতে তাকে একটি অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রাখা হতো। সকাল বেলা খালি পায়ে প্যারেড করতে বাধ্য করা হতো। এভাবে অমানুষিক নির্যাতনে তার বুকের ব্যথা, ঘাড়ের ব্যথাসহ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ব্যথা-বেদনার সৃষ্টি হয়। তিনি নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হন। যার ফলে ১৯৫৫ সালের ২ মে তাকে সামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়।
সাইয়েদ কুতুবের শিষ্য ইউসুফ আল আযম লিখেছেন- “সাইয়েদ কুতুবের ওপর বর্ণনাতীত নির্যাতন চালানো হয়। আগুন দ্বারা সারা শরীর ঝলসে দেওয়া হয়। পুলিশের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর লেলিয়ে দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থান রক্তাক্ত করা হয়। মাথার ওপর কখনো উত্তপ্ত গরম পানি ঢালা হতো। পরক্ষণে আবার খুবই শীতল পানি ঢেলে শরীর বরফের ন্যায় ঠান্ডা করা হতো। পুলিশ লাথি, ঘুষি মেরে একদিক থেকে অন্যদিকে নিয়ে যেত।”

সাইয়েদ কুতুবের ১৫ বছরের কারাদণ্ড ঃ মন্ত্রীত্বের টোপ
১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে সাইয়েদ কুতুবকে ১৫ বছর কারাদণ্ডের আদেশ শোনানো হয়। সে সময় তিনি এত বেশি অসুস্থ ছিলেন যে, সে আদেশটি শোনার জন্য আদালতের কাঠগড়ায় যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে তাঁর শরীর ভেঙ্গে পড়ে। তিনি পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হন। ১৯৬০ সালের শেষের দিকে সাইয়েদ কুতুব মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কারাগারের ভিতর তাঁর চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা করা হলো না। বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠলো তাঁকে কারাগারের বাইরে বিশেষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু কোন ফল হলো না। ৬ মাস পর আলমানিল হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু তার ৬ মাস পর পুনরায় তাঁকে কারা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সাইয়েদ কুতুবের এই অসুস্থতার পিছনে নির্যাতনই প্রধান কারণ ছিল। এমনও হয়েছে একাধারে ৪ দিন একই চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে। খানাপিনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তাঁর সামনে অন্যরা পানি পান করতো অথচ তাঁকে এক গ্লাস পানি দেওয়া হতো না।
আশ্চর্যের বিষয়, সাইয়েদ কুতুবের ওপর শারীরিক শত নির্যাতন সত্ত্বেও দাওয়াত, জিহাদ ও আন্দোলনের কাজ থেকে তাঁকে বিরত রাখা সম্ভব হয়নি। তিনি সময় পেলেই জেলে দাওয়াতী কাজ করতেন। ইখওয়ানুল মুসলিমীন নিয়ে ভাবতেন ও বিভিন্ন পরিকল্পনা করতেন। তিনি ঈমানী চেতনায় এত বেশি উদ্দীপ্ত ছিলেন যে, কোন সময়ই অন্যায়ের সাথে আপোস করতে চাননি। কারাগারে যাওয়ার ১ বছর পরই সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয় যে, যদি আপনি ক্ষমা চেয়ে কয়েকটি লাইন লিখে দেন, যা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করা হবে, তাহলে আপনাকে মুক্তি দেওয়া হবে। আপনি জেলের কষ্টকর জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে ঘরে আরামে থাকতে পারবেন। উক্ত প্রস্তাব শুনে সাইয়েদ জবাব দিলেন- “আমার অবাক লাগে যে, এ সকল লোকেরা মজলূমকে বলছে জালিমের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে। আল্লাহ্র শপথ! যদি কয়েকটি শব্দ উচ্চারণের ফলে আমাকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে নাজাত দেয় তবু আমি তা বলতে প্রস্তুত নই। আমি আমার রবের দরবারে এমনভাবে হাজির হতে চাই যে, আমি তাঁর উপর সন্তুষ্ট আর তিনি আমার উপর সন্তুষ্ট।”
জেলখানায় যখনই তাকে ক্ষমা চাইতে বলা হত, তিনি বলতেন- “যদি আমাকে কারাবন্দী করা সঠিক হয়, তাহলে সঠিক সিদ্ধান্তের উপর আমার সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আর যদি অন্যায়ভাবে আমাকে কারাগারে আটক রাখা হয়, তাহলে আমি জালিমের কাছে করুণা ভিক্ষা চাইতে রাজি নই।”
এরপর সরকারের পক্ষ থেকে টোপ দেয়া হয়, তিনি যদি সম্মত হন তাহলে
তাকে শিক্ষা মন্ত্রণায়ের দায়িত্ব দেয়া হবে। সাইয়েদ এ প্রস্তাব শুনে প্রতিক্রিয়ায় বলেন- “আমি দুঃখিত। মন্ত্রীত্ব গ্রহণ আমার পক্ষে সে সময় পর্যন্ত সম্ভব নয়, যতক্ষণ না মিসরের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামী ছাঁচে ঢেলে সাজাবার এখতিয়ার দেয়া না হবে।”
সাইয়েদ তাঁর বিশ্বাসে অটল রইলেন। জালিম শাসকের সাথে আপোস করেননি।
তাররা কারাগারে রক্তের স্রোত: সাইয়েদ কুতুবকে ‘তাররা’ কারাগারে রাখা হয়েছিল। সেখানে ইখওয়ানের আরও ১৮৩ জন কর্মী ছিল। তাদের সাথে পরিবার পরিজনকেও দেখা করতে দেয়া হত না। একবার ‘আব্দুল্লাহ্ মাহের’ ও ‘আব্দুল গাফফার’ নামক দু’জন ইখওয়ান কর্মীকে তাদের আত্মীয়-স্বজন দেখতে আসেন। কিন্তু তাদের সাথে আত্মীয়দের সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হয়নি, বরং তাদের দেখতে আসার শাস্তিস্বরূপ কারাগারে আটক রাখা হয়।
কারাবন্দী ইখওয়ান কর্মীরা উক্ত অমানবিক ঘটনার প্রতিকার চেয়ে কারা তত্ত্বাবধায়কের নিকট আবেদন জানান। কিন্তু ফল হল উল্টো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে কারাগারে অস্ত্রে সুসজ্জিত সৈন্যরা প্রবেশ করে। সৈন্যরা অগ্নিগোলা বর্ষণ করতে থাকে। ঘটনাস্থলেই ২১ জন ইখওয়ান কর্মী শাহাদাত বরণ করেন, ২৩ জন মারাত্মক আহত হন। রক্তে রঞ্জিত হয় তাররা কারাগার। এ ঘটনার পর মন্ত্রী পরিষদের সচিব সালাহ দাসুফী তদন্তে আসেন। তদন্তে কি হয় এ ভয়ে সকলেই তটস্থ হয়ে পড়ে। না, যাদের গুলিতে রক্তের স্রোত বইছে তাদের কিছুই হয়নি। ইখওয়ান কর্মীদের উপর কড়া নজর রাখার নির্দেশ দিয়ে চলে গেলেন জালিম সরকারের সচিব মহোদয়।

কারাগারের বিচারপতি অসুস্থ ঃ কারাসঙ্গী সকলেই তাঁর খাদেম
আল্লাহ্ সাইয়েদ কুতুবকে এক বিরাট যাদুকরী সম্মোহনী শক্তি দিয়েছিলেন। কারাগারের সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করতো, সম্মান করতো। তাঁর কাছে সকল কথা খুলে বলতো। কারাগারের বিভিন্ন বিষয় তিনি মীমাংসা করতেন। হাজতী, কয়েদীদের পরস্পরে ঝগড়া হলে তিনি বিচার করতেন। তাই তাঁকে উপাধি দেয়া হয় ‘কাজী উস সিজন’ (কারাগারে বিচারপতি)। যখন কোন কয়েদীকে অন্য স্থানে স্থানান্তর করা হত তিনি তাকে বিদায় দিতেন। তাঁকে খাবারের কোন কিছু দেয়া হলে তা অন্যদের মাঝে বিতরণ করতেন। জেল সুপার, জেল ডাক্তার সবাই তাকে ভালবাসতো। তিনি কারাবন্দীদের খোঁজ-খবর রাখতেন। এমনকি কারাগারে যেসব প্রাণী থাকতো, তিনি তাদেরও যতœ নিতেন, খাবার দিতেন। তিনি তাঁর আচরণে সবার মন জয় করেন।
একবার তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। কারাসঙ্গী অন্যরা তাঁর খিদমত করতেন। তিনি হাসপাতাল আঙ্গিনায় অন্যদের সাথে খোশ-গল্প করতেন। তিনি ছিলেন খুবই ধৈর্যশীল। ইখওয়ান নেতৃবৃন্দ পরামর্শের জন্য কারাগারে গেলে স্বাভাবিকভাবেই পরামর্শ দিতেন। কখনও কখনও ছোট বোন হামিদা কুতুবের মাধ্যমে পরামর্শ পাঠাতেন।
সাইয়েদের কারাজীবনে মানসিকতার কোন পরিবর্তন ঘটেনি। একবার আদালতের কাঠগড়ায় তিনি দাঁড়ানো। তাঁর ভাই-বোনেরা তাঁকে দেখতে এসেছেন। সবাইকে দেখে তিনি মুচকি হাসলেন। আল্লাহ্র কাছে দোয়া করলেন এবং ধৈর্যের উপদেশ দিলেন।
কারাগারেই তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন লেখা সমাপ্ত করেন: কারাগার খুবই কষ্টকর জায়গা। বিশেষতঃ যাদের উপর দৈহিক নির্যাতন চালানো হয় তাদের তকলিফের সীমা থাকে না। সাইয়েদ কুতুব কারাগারে বর্ণনাতীত নির্যাতনের সম্মুখীন হন। কিন্তু এ মহান চিন্তানায়কের কলম কারাগারেও সচল ছিল। কারাগারে বসেই অনেক বই লেখেন। ‘মায়ালিমু ফিততারিক’ (‘ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা’ নামে বাংলায় অনুবাদ হয়), ‘কিতাবু হাযাদদ্বীন’, ‘আল মুসতাকবিল লিহাযাদদ্বীন’, ‘আল ইসলাম ওয়া মুশকিলাতুল হাযারাহ’, ‘খাসায়েসু ছুয়ারিন ইসলাম’, ‘মুকাওয়ামমাতু তাসাব্বুরিল ইসলাম’ প্রভৃতি গ্রন্থ কারাগারেই রচনা করেন। তবে তাঁর সর্বশেষ্ঠ অবদান তাফসীর ‘ফী যিলালিল কুরআন।’ এ তাফসীরটি ১৯৫৪ সালে কারাগারে যাওয়ার পূর্বে লেখা শুরু করেন। আর কারাগারের ভিতরই লেখা সমাপ্ত হয়। সাইয়েদ সব সময় কুরআন নিয়ে ভেবেছেন। চিন্তা করেছেন। কুরআনের সূরাসমূহ নিয়ে হৃদয়ে ছবি এঁকেছেন।
তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে বিভিন্ন তাফসীরের সাহায্যে কুরআন বুঝার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোথাও কুরআনের স্বাদ, কুরআনের সৌন্দর্য, শৈশবের কুরআন তিলাওয়াতের মিষ্টি-মধুর আনন্দ অনুভব করলেন না। তাই তিনি তাফসীরের সাহায্যে কুরআন বুঝার বদলে কুরআনকে কুরআন দিয়েই বুঝার চেষ্টা করেন। এবার কুরআনের প্রাণস্পর্শী আবেদন তাঁর হৃদয়ে নাড়া দিলো। কুরআনের সাথে ভালবাসা সৃষ্টি হল। কুরআনের কথাগুলো মানুষের জীবনের সাথে মিলিয়ে তিনি মর্মোদ্ধারের প্রয়াস চালালেন।
১৯৩৯ সালে ‘আল মুকতাতাফ’ ম্যাগাজিনে ‘আত তাসবিরুল ফান্নী ফিল কুরআন’ শিরোনামে কুরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা দিয়ে প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। তিনি বর্তমান সমাজ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে লাগলেন। তিনি দেখলেন বস্তুগত দর্শন মানুষকে মুক্তি দিতে পারছে না। আল্লাহ্ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা থেকে দূরে সরে গিয়ে মানব রচিত চিন্তা ও দর্শনের আলোকে সমাজ পরিচালিত হওয়ায় সমাজে এত দুঃখ-দুর্দশা। মূলতঃ কুরআনের আলোকে যে সমাজ পরিচালিত হয় না, তা জাহেলী সমাজ। এ সমাজ মানুষকে শান্তি ও মুক্তির পথ নির্দেশ করতে পারে না। আধুনিক জাহেলিয়াতে নিমজ্জিত মানবতার মুক্তি পেতে হলে কুরআনের ছায়াতলেই জীবন-যাপন করতে হবে। সাইয়েদ কুতুব তাঁর তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনে এ কথাই তুলে ধরেছেন।
১৯৫২ সালে ‘আল মুসলিমুন’ পত্রিকায় ‘ফী যিলালিল কুরআন’ (কুরআনের ছায়াতলে) শিরোনামে লেখা শুরু করেন। ফেব্র“য়ারী মাসে প্রথম লেখা ছাপা হয়। সূরা বাকারার ১০৩ নং আয়াত পর্যন্ত প্রথম স্তরে লেখেন। এরপর কিছুদিন লেখা বন্ধ থাকে। ৫২ সালের অক্টোবর মাস থেকে পুনরায় লেখা শুরু করেন। ৫৪ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত ১৬ পারা ছাপা হয়। ১৯৫৪ সালে তাঁকে কারাগারে নেয়া হয়। সরকার কারাগারে লেখালেখিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কারাগারে কাগজ-কলম ছিল না। কারো কাছে কাগজ-কলম পাওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু সাইয়েদ পেরেশান ছিলেন তাফসীর লেখার জন্য। তিনি তাফসীর প্রকাশের জন্য একজন প্রকাশকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। প্রকাশক নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলে আদালত লেখালেখির অনুমতি দেন। সাইয়েদের তাফসীর লেখার কাজ পুনরায় শুরু হয়। সরকারের পক্ষ থেকে শাইখ মোহাম্মদ গাযালীকে ফী যিলালিল কুরআনের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করা হয়। তিনি দেখে দেয়ার পর তা ছাপা হত। সাইয়েদ কুতুব কারাগারেই ফী যিলালিল কুরআন সমাপ্ত করেন।
১৯৬৪ সালে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি নতুন আঙ্গিকে কুরআনের তত্ত্ব ও মহত্ব উদঘাটনের চেষ্টা করেন। এ দৃষ্টি ভঙ্গিতেই শেষ তিন পারা, একাদশ, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ পারা লেখেন। আশা করেছিলেন এভাবে সাতাশ পারা পর্যন্ত লিখবেন। কিন্তু তাঁর সে আশা পূরণ হল না।
তাফসীর ‘ফী যিলালিল কুরআন’ সাইয়েদ কুতুবের অমর সৃষ্টি: নতুন আঙ্গিকে এ তাফসীরটি লিখিত। তিনি এক নজরে সম্পূর্ণ সূরার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা করেছেন। অতঃপর আয়াতগুলোকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ শব্দের বিশ্লেষণ করেছেন। এ তাফসীরটি ফিক্হী দ্বন্দ্বমুক্ত। কুরআন মাজীদ আল্লাহ্র পথে দাওয়াত দেয়ার যে টেকনিক পেশ করেছে, সে দৃষ্টিতে এটি ‘দাওয়াত ইলাল্লাহ্’র জন্য উত্তম তাফসীর। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় সুন্দরভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে এ তাফসীরে। এদিক থেকে এটি বৈজ্ঞানিক তাফসীর। সাইয়েদ কুতুব একজন অন্যতম সেরা সাহিত্যিক। তিনি সাহিত্যিক হিসেবেই এ তাফসীরের বাক্যবিন্যাস, শব্দচয়ন ও উপস্থাপনা করেছেন। আধুুনিক জাহেলিয়াত থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করতে তিনি ছিলেন অগ্রসেনানী। তাই তাঁর তাফসীর পড়ে মনের মাঝে জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্’র জযবা পয়দা হয়।

কারাগার থেকে মুক্তি ঃ ভিত্তিহীন অপপ্রচার
সাইয়েদ কুতুব ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন। প্রথম তিন বছর চরম নির্যাতনের সম্মুখীন হন। আত্মীয়-স্বজনদেরকেও দেখা করতে দেয়া হত না। পরবর্তীতে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সাথে সাক্ষাতের অনুমতি দেয়া হয়। লেখালেখির সুযোগ দেয়া হয়। তাঁকে পনের বছরের সশ্রম করাদণ্ড দেয়া হয়।
১৯৬৪ সালে ইরাকের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আব্দুস সালাম আরিফ কায়রো সফর করেন। ইরাকের আলিমদের আবেদনে ইরাকী প্রেসিডেন্ট মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাসেরের সাথে বৈঠককালে সাইয়েদ কুতুবকে মুক্তি দেয়ার অনুরোধ জানান। ইরাকের প্রেসিডেন্টের সাথে নাসেরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। নাসের এ ঘনিষ্ঠতা আরো বৃদ্ধি করতে আগ্রহী ছিলেন। তাই সাইয়েদকে মুক্তি দেন। মুক্তির পর কারাগারের উপকণ্ঠে অবস্থানকালে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কড়া দৃষ্টি রাখে, কারা কারা সাইয়েদের সাথে দেখা করতে আসে তা জানার জন্যে। সে সময় সাইয়েদের পরামর্শ নেয়ার জন্য সারা বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ তাঁর কাছে ছুটে আসতেন।
জেল থেকে মুক্তির পর সাইয়েদকে ঘিরে এক মজার অপপ্রচার শুরু হয়। ইসলাম বিরোধী বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা হয়- “সাইয়েদ কুতুব ইসলামের কথা বলেন, অথচ তাঁর জীবনে ইসলাম নেই। সাইয়েদ কুতুব জেল থেকে মুক্তি পাবার পর কায়রোর পথ দিয়ে যাবার সময় তাঁর সাথে ছিল তার স্ত্রী ও বড় মেয়ে। তাঁরা উভয়ে ছিল নগ্নপ্রায়। তাঁদের মাথায় স্কার্ফ পর্যন্ত ছিল না।”
এ ধরনের ভিত্তিহীন অপপ্রচারের সম্মুখীন হন সাইয়েদ কুতুব। অথচ তিনি বিয়েই করেননি। তিনি জীবনে দুবার বিয়ের আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি যখন গ্রামে ছিলেন তখন দূর সম্পর্কের আত্মীয়ার সাথে বিয়ের কথা হয়। কিন্তু তিনি যখন গ্রাম থেকে কায়রোতে চলে যান তখন সে মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। মন্ত্রণালয়ে চাকরি পাবার পর গ্রামের সেই মেয়েটির অনুরূপ আরেকটি মেয়ের সাথে বিয়ের কথা হয়। কিন্তু মেয়ের বয়স কম হওয়ায় পরে বিয়ে দেয়া হবে বলে মেয়ের পরিবার জানায়।
এরপর তিনি আমেরিকা চলে যান। আমেরিকা থেকে ফিরে এসে ব্যস্ত জীবন কাটান। ঐ মেয়েটিরও বিয়ে হয়ে যায়। কিছুদিন পর আবার বিয়ের প্রস্তাব করেন। একস্থানে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন ভাবছিলেন। কিন্তু বিয়ের পূর্বেই তিনি আবার ৫৪ সালে গ্রেফতার হন। ১৯৬৪ সালে কারামুক্তির পর আবার বিয়ের কথা চিন্তা করেন। সে সময় তাঁর বয়স হয় ৫৯ বছর। কিন্তু ৬৫ সালে পুনরায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং ১৯৬৬ সালে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এভাবেই তিনি আল্লাহ্র সান্নিধ্যে চলে যান। জীবনে তিনি কোন নারীর সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হননি। তবু তিনি অনেক ভিত্তিহীন অপপ্রচারের শিকার হন।
সাইয়েদ কুতুবকে পূনরায় গ্রেফতার: সাইয়েদ কুতুব প্রথমবার জেল থেকে মুক্তির পর কায়রোতে নিযুক্ত ইরাকী রাষ্ট্রদূত তাঁর সাথে দেখা করেন। সাক্ষাৎকালে তিনি সাইয়েদকে ইরাকে সম্মানজনক চাকুরীর প্রস্তাব দেন। সাইয়েদ প্রতিউত্তরে বলেন- “আমি মিসরের অধিবাসী। মিসরেই আমি জন্মেছি। দেশের প্রতি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। আমি দেশেই অবস্থান করবো। আমি দুঃখিত এ জন্য যে, আপনার প্রস্তাবিত পদ গ্রহণ করতে পারছি না।”
সাইয়েদ দেশের বাইরে গেলেন না। দেশের প্রতি তাঁর দরদ ছিল, মমতা ছিল বলেই। কিন্তু দেশের সরকার অজুহাত খুঁজছেন কিভাবে তাঁকে আবার গ্রেফতার করা যায়। এ জন্য একটি নাটক সাজানো হলো, এক গোয়েন্দা পুলিশ পকেটে ইখওয়ানের সদস্য ফরম রেখে জামাল আব্দুন নাসেরের জনসভায় যায়। সভার কাজ শুরু হলে সে নাসেরকে লক্ষ্য করে পরপর ১২ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। কিন্তু গুলি কারো গায়ে লাগেনি এবং যে ব্যক্তি গুলি ছুঁড়েছে সেও পালাবার কোন চেষ্টা করেনি। পুলিশ গ্রেফতার করে ঐ ব্যক্তিকে নাসেরের সামনে নিয়ে গেলো। নাসের বললো, তার পকেট তল্লাশী করে দেখো ইখওয়ানের কোন কাগজ আছে কি না। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে বলতে শুরু করলো, হ্যাঁ, আমি ইখওয়ানের লোক। প্রেসিডেন্টকে হত্যা করার জন্য ইখওয়ান আমাকে পাঠিয়েছে। সাথে সাথে পুলিশের লোকেরা চিৎকার করে উঠলো, স্যার, এই যে দেখুন ইখওয়ানের সদস্য ফরম তার পকেটে।
নাসের তো এই অজুহাতটির খোঁজেই ছিল। সাথে সাথে শুরু হল গণ গ্রেফতারী। মিসরের প্রেসিডেন্ট ইখওয়ান কর্মীদের বিচারের জন্য স্পেশাল সামরিক আদালত বসালেন। এক অধ্যাদেশ জারি করে গণ গ্রেফতারীর বিরুদ্ধে আদালতে আপীল করার সুযোগ রহিত করেন। সাইয়েদ কুতুবকে মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদার আখ্যায়িত করে ইখওয়ানকে তার পদাঙ্কানুসারী বলে প্রচারণা চালিয়ে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন। সে সময় চল্লিশ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। সাইয়েদ কুতুব দ্বিতীয়বার গ্রেফতার হলেন। এবার গ্রেফতারী পরওয়ানা দেখে নিজেই নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, আমি জানি জালিমরা এবার আমার মাথাই চায়। তাতে আমার কোন দুঃখ নেই। নিজের মৃত্যুর জন্য আমার কোন আক্ষেপ নেই। আমার তো বরং সৌভাগ্য যে, আল্লাহ্র রাস্তায় আমার জীবনের সমাপ্তি হতে যাচ্ছে। আগামী কালের ইতিহাসই এটা প্রমাণ করবে যে, ইখওয়ানুল মুসলিমীন সঠিক পথের অনুসারী ছিল, নাকি এই জালিম শাসকগোষ্ঠী সঠিক পথে ছিল।
গ্রেফতারকৃতদের মাঝে সাইয়েদা জয়নাব আল গাযালীও ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ষাট বছরের বেশি। তিনি ছিলেন মহিলা সংগঠনের নেত্রী। তাঁকে দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। হাসান হোদাইবী, তাঁর ছেলে মামুন আল হোদাইবী ইসমাইল, তাঁর মেয়ে সাইয়েদা খালেদা, স্ত্রী ও পুত্রবধূকেও কারাগারে আটক করা হয়। কারাবন্দী নারী-পুরুষের উপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন।
একজন মহিলা যিনি দ্বীন প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন তাঁর ভাই ও তাঁকে জেলে আনা হয়। ভাইকে বলা হয়, তুমি লেখো আমার বোন দুশ্চরিত্রা মহিলা এবং দেহ ব্যবসায়ী।
তিনি এ কথা লিখতে অস্বীকার করায় তার উপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়।
বোন তাকে আবেদন জানায়- ‘ভাইয়া, আপনি এ কথা লিখে দিন এবং শাস্তির হাত থেকে জীবন রক্ষা করুন।’
ভাই বোনকে বললেন- ‘বোন, তুমি আমার জন্য উত্তম আদর্শ এবং আমিও তোমার জন্য আদর্শ হয়ে থাকবো।’
এরপর ভাই নির্যাতনে শাহাদাত বরণ করেন।
শাওকী আব্দুল আযীয নামক একজন ইখওয়ান কর্মীকে সম্পূর্ণ নগ্নদেহে ছাদে লটকানো হয়। তারপর ফোঁটা ফোঁটা পেট্রোল তার মাথায় ঢালা হয়। তখন তার দম বন্ধ হয়ে আসতো। প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টা এ শাস্তি চলতো। জেল দারোগা কটাক্ষ করে তাকে জিজ্ঞেস করতো, তুমি কি এখনও পাক্কা মোমেন রয়েছো? তিনি জবাব দিতেন- “হে আল্লাহ্! তুমি যদি আমার ওপর অসন্তুষ্ট না হও তাহলে এ শাস্তিকে আমি পরওয়া করি না।”
একথা শোনার পর তাঁকে আরও চাবুক মারা হত। গায়ে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরা হত। মহিলাদের কাঠের সাথে বেঁধে অর্ধনগ্ন করে নির্যাতন করা হত। রক্ত ও পুঁজে তাদের শরীর ভরে যেত। পুরুষদের কাপড় খুলে শিশুর মতো উলঙ্গ করে হাত কাঁধ পর্যন্ত উঁচু করে রাখতে বাধ্য করা হত। লোহার শিকলের সাথে বেঁধে হিংস্র কুকুর ছেড়ে দিত। অনেককে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করত। ভাইয়ের সামনে বোনকে বিবস্ত্র করা, অবিরাম ক্ষুধার্ত রাখা, বৈদ্যুতিক শক দেয়া, ঘুমাতে না দেয়া এসব ছিল শাস্তিপ্রদানের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
সাইয়েদ কুতুবের ভাই-বোনদের কারাবরণ: সাইয়েদ কুতুবের পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও কারা নির্যাতন ভোগ করেন। সাইয়েদের ছোট ভাই মোহাম্মদ কুতুব। ১৯৬৫ সালের জুলাই মাসে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে গ্রেফতার করে কোথায় রাখা হয়েছে তা কেউ জানতো না। তাকে এত বেশি অত্যাচার করা হয় যে, তাঁর দিকে তাকালে তাঁকে চেনাই যেত না। তিনি ইখওয়ানের নেতা ছিলেন না। তিনি লিখতেন। তাঁর লেখনিতে ইখওয়ান কর্মীরা উদ্দীপ্ত হত। এটাই ছিল তাঁর অপরাধ।
সাইয়েদের পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন হামিদা কুতুব। ছোটবেলা থেকে সাহিত্য চর্চার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি কারারুদ্ধ ইখওয়ান নেতা- কর্মীদের সেবা-যতœ করতেন। সাইয়েদ কুতুবের বাণী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের কাছে পৌঁছাতেন। তিনিও বর্ণনাতীত নির্যাতনের শিকার হন। তাঁকে দশ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়। ছয় বছর চার মাস কারাবরণের পর তিনি মুক্তি পান। ড. হামুদী মাসউদের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। বর্তমানে তাঁরা ফ্রান্সে বসবাস করছেন।
সাইয়েদের আরেক বোন আমিনা কুতুব। তিনি উচ্চ শিক্ষিতা এক মহিলা ছিলেন। দাওয়াত ও জিহাদের ময়দানে আপন ভাইয়ের সাথে শরীক ছিলেন। সমাজ সংস্কারে তিনি অনেক লেখালেখি করেন। তিনিও অনেক নির্যাতন ভোগ করেন। দীর্ঘদিন কারাগারে অন্তরীণ থাকেন। কারাগারেই ১৯৫৪ সালে কামাল ছানানী নামক জনৈক ইখওয়ান কর্মীর সাথে দেখা হয়। সেখানে থেকেই বিয়ের প্রস্তাব। কারামুক্তির পর উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৮১ সালে আনোয়ার সাদাত হাজার হাজার ইখওয়ান কর্মীকে গ্রেফতার করে। কামাল ছানানীও গ্রেফতার হন। কারাগারে পাশবিক নির্যাতনে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
সাইয়েদ কুতুবের আরেক বোন যার নাম খুবই কম শোনা যায়, তিনি হচ্ছেন নাফীসা কুতুব। তাঁকেও অনেক কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাঁর বড় ছেলের নাম রিফাত। সে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। তাকেও গ্রেফতার করা হয়। মামার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে নির্যাতন চালানো হয়। কিন্তু তিনি রাজি হননি। নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। কারার চার দেয়ালের ভিতরই তিনি শহীদ হন। সাইয়েদের অপর ভাগিনার নাম আযম। সে মেডিক্যালের ছাত্র ছিল। তাকেও কারাগারে অন্তরীণ করা হয়।
সাইয়েদ কুতুবের ভাই-বোন সকলেই কারা নির্যাতনের সম্মুখীন হন। ধৈর্যের সাথে তাঁরা ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
সাইয়েদ কুতুবকে জিজ্ঞাসাবাদ: সাইয়েদ কুতুবকে গোয়েন্দা বিভাগের তদন্ত কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়। ১৯৬৫ সালের ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬.১০ মিনিট থেকে রাত ১০.৩০ মিনিট পর্যন্ত এবং পরের দিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ চলে। ২১ ডিসেম্বর দুপুর ১টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ চলে। সাইয়েদ কুতুবকে জিজ্ঞাসাবাদে যেসব প্রশ্ন করা হয় তিনি বলিষ্ঠতার সাথে স্পষ্ট ভাষায় সেসব প্রশ্নের জবাব দেন তা নিুরূপঃ
প্রশ্ন ঃ আপনার নাম, ঠিকানা, পেশা ও বয়স বলুন।
জবাব ঃ নাম সাইয়েদ, পিতা ইবরাহীম। উসয়ূত জেলার মুশা গ্রামে জন্ম। বর্তমানে হালওয়ানের ৪৪ হায়দার রোডে বাস করছি। পেশায় একজন লেখক, বয়স ৬০।
প্রশ্ন ঃ আপনি কি কারাগারের ভিতরে লেখালেখি করছেন ?
জবাব ঃ হ্যাঁ, আমি আমার আকিদা-বিশ্বাস ও চিন্তাধারা তুলে ধরে কিছু বই লিখেছি। ইসলামী জীবন দর্শন নিয়ে লিখেছি।
প্রশ্ন ঃ এ সম্পর্কে হাসান হুদাইবী কি অবগত আছেন?
জবাব ঃ আমার ধারণা তিনি অবহিত আছেন।
প্রশ্ন ঃ এর আগে কারাগার থেকে বের হবার পর আপনি কি হাসান হুদাইবীর মুখোমুখি হয়েছেন?
জবাব ঃ হ্যাঁ, আমার ঘরে তাঁর সাথে তিনবার সাক্ষাৎ হয়েছে। তিনি এবং আমি ছাড়া তখন কেউ উপস্থিত ছিল না।
প্রশ্ন ঃ আপনাদের সংগঠনের অর্থ বিদেশ থেকে অর্থাৎ সাউদি আরব ও অন্যান্য দেশ থেকে আসে, তাই না?
জবাব ঃ হ্যাঁ, আমাদের আকীদা ও চিন্তাধারায় যারা বিশ্বাসী পৃথিবীর যেকোন দেশেই থাকুক না কেন, তাঁরা আমাদের ভাই। তাঁদের সাথে আমাদের আত্মিক সম্পর্ক বিদ্যমান। কিন্তু কোন দেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক নেই।
প্রশ্ন ঃ আপনি যে সম্পর্কের কথা বলেছেন তা ইখওয়ানের সাংগঠনিক দৃষ্টিতে, ইসলামের দৃষ্টিতে নয়, তাই না?
জবাব ঃ ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিই ইখওয়ান গ্রহণ করেছে।
প্রশ্ন ঃ আপনার দৃষ্টিতে যেসব মুসলিম ইখওয়ানের সাথে সম্পৃক্ত এবং যারা সম্পৃক্ত নয় তাদের মাঝে পার্থক্য কি?
জবাব ঃ ইসলাম বাস্তবায়নে ইখওয়ান কর্মীদের কাছে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী রয়েছে। আর অন্যদের নেই। আমার দৃষ্টিতে তারাই উত্তম, ইসলাম প্রতিষ্ঠায় যাদের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী আছে।
প্রশ্ন ঃ আপনি কি বিশ্বাস করেন, যারা ইখওয়ানের সাথে সম্পৃক্ত তারা ‘ফী সাবিলিল্লাহ্’র কাজ করছে?
জবাব ঃ এটা নির্ভর করছে যারা ইখওয়ানের সাথে জড়িত তাদের নিয়ত ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর।
প্রশ্ন ঃ সাঈদ রমদান সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? তিনি ইসলামের নামে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে মানুষদের সংগঠিত করছেন।
জবাব ঃ আমি এ প্রশ্নের জবাব দান থেকে ক্ষমা চাই।
প্রশ্ন ঃ আপনার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের পথ কি?
জবাব ঃ আমাদের লক্ষ্য ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা, মানব রচিত বিধান নয়। এ কারণে লোক তৈরির জন্যে ইসলামী প্রশিক্ষণের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে।
প্রশ্ন ঃ আপনার সংগঠন কি গোপনে না প্রকাশ্যে তৎপরতা চালাচ্ছে?
জবাব ঃ গোপনে।
প্রশ্ন ঃ যখন দ্বীনি চরিত্র গঠনই আপনাদের প্রশিক্ষণের লক্ষ্য, তাহলে গোপনে তৎপরতার হেতু কি?
জবাব ঃ প্রকাশ্য তৎপরতা ও প্রশিক্ষণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি আছে।
প্রশ্ন ঃ আপনি কি মনে করেন উম্মতে মুসলিমা দীর্ঘদিন ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন?
জবাব ঃ এ প্রশ্নের জবাব বিস্তারিত ব্যাখ্যার দাবি রাখে। তবে তারাই উম্মতে মুসলিমার অন্তর্ভুক্ত যারা ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনেতিক অর্থাৎ জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ্র বিধান মেনে চলে।
প্রশ্ন ঃ বর্তমানে আমাদের দেশে প্রচলিত বিধানকে কি জাহেলী বিধান মনে করেন?
জবাব ঃ আমি মনে করি এটা গায়রে ইসলামী বিধান।
প্রশ্ন ঃ আপনি কি মনে করেন এটা জাহেলী সমাজ ও গায়রে ইসলামী সমাজ?
জবাব ঃ এখানে জাহেলী সমাজের সংমিশ্রণ রয়েছে।
প্রশ্ন ঃ আপনার এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে মিসরের বর্তমান শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
জবাব ঃ আমি এটাকে জাহেলী ব্যবস্থা মনে করি।
প্রশ্ন ঃ এর অর্থ কি এটা যে, আপনি বর্তমান প্রচলিত শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন মনে করেন?
জবাব ঃ আমি মনে করি, ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উপাদানসমূহ পরিবর্তন হবে।
প্রশ্ন ঃ আপনার মতে ‘তাগুত’ অর্থ কি?
জবাব ঃ আমার মতে ‘তাগুত’ মানে আল্লাহ্র শরীয়তের বিপরীত অন্য সকল ব্যবস্থা।
প্রশ্ন ঃ ‘আল হা-কিমাতু লিল্লাহ্’ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?
জবাব ঃ আল্লাহ্ প্রদত্ত শরীয়তকে জীবন যাপনের বিধান হিসাবে গ্রহণ করা।
প্রশ্ন ঃ আপনি এটা কিভাবে বুঝলেন?
জবাব ঃ ইসলামের উপর অধ্যয়নের ফলে।
প্রশ্ন ঃ আপনি কি জানেন, প্রাচীন যুগে খারেজীরা এ পরিভাষা বলতো।
জবাব ঃ ঐতিহাসিক এ তথ্য আমার জানা নেই। এ পরিভাষা যখন তারা ব্যবহার করতো আমি যা বুঝি তা হচ্ছে আল্লাহ্ প্রদত্ত শরীয়তই হবে জীবন বিধান। কেননা, আল্লাহ্ নিজে হুকুম দেওয়ার জন্যে আসেন না। তিনি শরীয়াত নাযিল করেছেন, যেন তার ভিত্তিতে সকল কিছু পরিচালনা করা হয়। তাই ‘হা-কিমাতু লিল্লাহ্’ বলতে বুঝায় আল্লাহ্ প্রদত্ত বিধান
বাস্তবায়ন। আর এটা কুরআন দ্বারা প্রমাণিত।
প্রশ্ন ঃ আপনি কি আপনার এ চিন্তাধারা মাওলানা মওদূদীর সাহিত্য থেকে নকল করেছেন?
জবাব ঃ আমি ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করা কালীন মাওলানা মওদূদীর গ্রন্থ এবং অন্যদের গ্রন্থ দ্বারা উপকৃত হয়েছি।
প্রশ্ন ঃ মাওলানা মওদূদীর আহ্বান এবং আপনার আহ্বানের মধ্যে পার্থক্য কি?
জবাব ঃ কোন পার্থক্য নেই।
প্রশ্ন ঃ সংগঠনে সামরিক কায়দায় অস্ত্র-প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা কি?
জবাব ঃ শত্র“তা ও বাড়াবাড়ি প্রতিরোধের জন্য, যখন কারো বাড়াবাড়ির সম্মুখীন হতে হয়। আমার দৃষ্টিতে বাড়াবাড়ির ধরন হচ্ছে কারা নির্যাতন, হত্যা, বিচারপূর্ব নানা ধরনের দমন-পীড়ন, যেমন ১৯৫৪ সালে করা হয়েছিল।
প্রশ্ন ঃ এটার দ্বারা বুঝা যায় আপনারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, আপনাদের সংগঠন সালতানাতের মোকাবেলা করতে সক্ষম?
জবাব ঃ যে শক্তিকে আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, তা সরকারের শক্তি হিসেবে পরিগণিত নয়। আর এর বিরোধিতা করা সরকারের বিরোধিতার অন্তর্ভুক্ত নয়।
প্রশ্ন ঃ আপনি কি জানেন এ ধরনের সংগঠন করা আইন পরিপন্থী?
জবাব ঃ আমি জানি এটা আইন পরিপন্থী। কিন্তু আমি এটা করতে বাধ্য হয়েছিলাম। যদিও এটা প্রচলিত আইন পরিপন্থী, কিন্তু সফলভাবে ইসলামী তারবিয়্যাত দেওয়ার জন্য এর বিকল্প ছিল না।
প্রশ্ন ঃ তারবিয়্যাতের জন্য প্রচলিত আইনের বিরোধিতা কিভাবে করছেন? ইসলামী শরীয়ত কি এটা অনুমোদন করে? অথচ দেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হচ্ছে ইসলাম।
জবাব ঃ প্রচলিত আইন একজন মুসলিমকে ‘মুসলিম’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে বাধা প্রদান করে, স্বয়ং প্রচলিত আইনের এটা ত্র“টি ছাড়া কিছুই নয়।
প্রশ্ন ঃ কিভাবে দেখলেন প্রচলিত আইন একজন মুসলিমকে ‘মুসলিম’ হিসেবে বাধা প্রদান করছে?
জবাব ঃ ইখওয়ানুল মুসলিমুনের প্রকাশ্য তৎপরতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ ইখওয়ান দ্বীনি দায়িত্ব পালনেরই চেষ্টা করছে।
প্রশ্ন ঃ ‘ইখওয়ানুল মুসলিমুন’ নিষিদ্ধ করার কারণ কি দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের জন্যই?
জবাব ঃ হ্যাঁ, আমি এ কারণকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছি।
প্রশ্ন ঃ সংগঠন নিষিদ্ধ করার প্রেক্ষাপট কি জানেন?
জবাব ঃ আমি জানি সরকারি সিদ্ধান্তেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকার কি কারণে করেছে, তা আমার জানা নেই। আমি বিশ্বাস করি, ইখওয়ানের দ্বীনি তৎপরতার কারণেই একে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেননা, এটি একটি ইসলামী আন্দোলন। ইসলাম বিরোধীদের মোকাবেলায় এটা এক বিপ্লবী শক্তি।
প্রশ্ন ঃ কিন্তু ইখওয়ান নিষিদ্ধ করা হয়েছে তার গোপন সংগঠনের ধ্বংসাত্মক তৎপরতার কারণে!
জবাব ঃ আমি যা জানি তা হচ্ছে ইখওয়ানের গোপন সংগঠন রয়েছে। আমি এটাও জানি যে, সংগঠন নিষিদ্ধের এটা কোন প্রত্যক্ষ কারণ নয়। বরং মূল কারণ হচ্ছে বাইরের চক্রান্ত। স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্র এটা মেনে নিতে পারে না, কিন্তু আপসে এ ধরনের গোপন সংগঠন নিষিদ্ধ করা সম্ভব। ইখওয়ানকে প্রকাশ্য তৎপরতার সুযোগ দিলেই তা সম্ভব হত।
প্রশ্ন ঃ আপনি কি মনে করেন একমাত্র ইখওয়ানই দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ করছে?
জবাব ঃ আমি মনে করি ‘ইখওয়ানুল মুসলিমূন’ অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অধিকতর সফলতার সাথে দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত। এর মধ্যে যে সকল ত্র“টি আছে তা আমি নিঃসন্দেহে স্বীকার করি। কিন্তু ইখওয়ান দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যই চূড়ান্তভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
প্রশ্ন ঃ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ স্বীকার করেছেন যে, আপনি তাদের বুঝিয়েছেন বর্তমান জাহেলী সমাজের মধ্যে তারাই প্রকৃত মুমিন। তাঁরা দেশ, সমাজ ও প্রচলিত বিধানের সাথে কোন ধরনের সম্পর্কই রাখছে না। তাঁরা এমন মুসলিম হিসেবে নিজেদের মনে করে যে, তাঁরা রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধাবস্থায়ই রয়েছে। আপনি তাঁদের কাছে দেশকে অভিহিত করেছেন ‘দারুল হরব’ হিসেবে। এটা কি ‘ইসলামী ইসতেলাহ।’ আর এরই ভিত্তিতে যে কোন ধরনের হত্যাযজ্ঞকে ক্ষতিকর ও শাস্তিমূলক মনে করা না হয় বরং উল্টো পুণ্যের কাজ বলে মনে করা হয়?
জবাব ঃ এ ধরনের মনে করা ভুল। মুমিন সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি সবার নিকট সুস্পষ্ট। দারুল হরব ও দারুল ইসলামের সাথে উম্মতে মুসলিমার সম্পর্ক আছে। এ প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য ছিল দার্শনিক দৃষ্টিতে বিধান বর্ণনা করার জন্য, বর্তমান সময়ে একথা চালিয়ে দেয়ার জন্য নয়। আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে, তাঁরা আমার কথা ভুল বুঝেছে।
প্রশ্ন ঃ কিভাবে তারা বুঝার ক্ষেত্রে ভ্রান্তিতে আছে? বিশেষত তাদের একজন- যার নাম ‘আলী ওসমানী’ স্বীকারোক্তি দিয়েছে যে, আপনার সাথে মুসলিমদের হত্যার সম্পর্কে আলোচনা করা এই যে, যে ব্যক্তি ‘লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ্্’ বলবে তাঁকে হত্যা করা হারাম। এতদসত্ত্বেও আপনি মুসলমানদের হত্যার ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছেন?
জবাব ঃ এ ধরনের আলোচনার কথা আমি স্মরণ করতে পারছি না। এটা ঠিক যে, আত্মরক্ষার অধিকার সকলের রয়েছে।
প্রশ্ন ঃ আপনারা যে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তার সাথে বর্তমান প্রচলিত ব্যবস্থার বিরোধ কি?
জবাব ঃ প্রচলিত মানব রচিত বিধানে আল্লাহ্র শরীয়ত নেই। আমাদের দাবি হচ্ছে আল্লাহ্র শরীয়তই হবে জীবন বিধান। আমার মতে এটাই প্রধান বিরোধ। এ কারণেই ছোট-খাট আরো অনেক বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রশ্ন ঃ মুহাম্মদ কুতুব কি আপনার এই গোপন সংগঠন সম্পর্কে অবহিত?
জবাব ঃ না।
প্রশ্ন ঃ কেন তাঁকে এ সম্পর্কে অবহিত করেননি অথচ তিনি তাঁর রচিত পুস্তকে আপনার চিন্তাধারাই প্রকাশ করছেন?
জবাব ঃ আমি মুহাম্মদ কুতুবের অবস্থা জানি। কোন সংগঠনের সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে সে অনাগ্রহী। অপর দিকে আমি চেয়েছিলাম, অন্য কেউ এ সংগঠন সম্পর্কে না জানুক। যদিও সে আমার নিকটজন।
এভাবেই সাইয়েদ কুতুবকে আরো কিছু প্রশ্ন করা হয়। কিন্তু তিনি সাহসিকতা ও বলিষ্ঠতার সাথে সুস্পষ্টভাবে সকল প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি যা বিশ্বাস করতেন তাই প্রকাশ করেছেন।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বিচারের প্রহসন শুরু: ১৯৬৫ সালের ২১ ডিসেম্বর সাইয়েদ কুতুব ও তাঁর সঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়। ১৯৬৬ সালের ৩ ফেব্র“য়ারি এক সাংবাদিক সম্মেলনে মিসরের আইন মন্ত্রী ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন। তাদের মধ্যে ৩৮ জন ছিলেন কারাগারে। ৩জন ছিলেন পলাতক এবং ২ জন ছিলেন মহিলা। একজন যয়নাব আল গাযালী আরেক জন হামিদা কুতুব। বিচার প্রহসন শুরু হল। অভিযুক্তদের কোন কৌশলী নেই। আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ নেই। সুদান, মরক্কোসহ কয়েকটি আরব দেশের আইনজীবীরা সেদেশে এসেছিলেন সাইয়েদ কুতুব ও তাঁর সাথীদের মামলা পরিচালনার জন্য। তাদের সবাইকে কায়রো বিমান বন্দর থেকেই ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। ফরাসী বার এসোসিয়েশনের সভাপতি ‘উইলিয়াম থরপ’ মামলার কাজে কায়রো আসার অনুমতি পাননি। পর্যবেক্ষক পাঠাতে চেয়েও সফল হননি। বিচারকক্ষে কোন সাংবাদিক, বিদেশী নাগরিক, জনপ্রতিনিধি এমনকি সাধারণ মানুষকেও ঢুকতে দেয়া হয়নি। টেলিভিশনে এই বিচার অনুষ্ঠান দেখানোর কথা থাকলেও অভিযুক্তরা অভিযোগ অস্বীকার করে কারা নির্যাতনের বর্ণনা দিতে শুরু করলে সম্প্রচারের সিদ্ধান্তই বাতিল করা হয়। সাইয়েদ কিছু বলতে চাইলেও তাঁকে কিছু বলতে দেয়া হল না। এমনি অবস্থায় ১৮ মে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত আদালতে বিচার প্রহসন নাটক মঞ্চস্থ হয়।
রায়ের অপেক্ষায় সাইয়েদ কুতুব: ১৮ মে ১৯৬৬ জেরা সমাপ্ত হয়। চার মাস অতিবাহিত হল। সাইয়েদ রায়ের অপেক্ষা করছেন। রায় কি হবে তা আগেই জানা। তাই মৃত্যুদণ্ডের প্রহর গুণছেন। এ সময় আহমদ রায়েফের সাথে জেলখানায় তাঁর দেখা হয়। তিনি জানতে চাইলেন- “আপনি কিসের জন্য অপেক্ষা করছেন?”
সাইয়েদ কুতুব প্রসন্ন চিত্তে বললেন- “আমি আমার রবের সাথে মিলিত হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছি।”

সাইয়েদের পক্ষে চিঠি ঃ সাবেক মন্ত্রী কারাগারে
কামাল উদ্দিন হুসাইন মিসরের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী। সাইয়েদকে তিনি ভাল জানতেন। তাই তিনি মিসরের প্রেসিডেন্টকে চিঠি লেখেন যা নিুরূপঃ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
প্রতি,
আস সাইয়েদ জামাল আব্দুন নাসের
প্রেসিডেন্ট, মিসর প্রজাতন্ত্র।
জনাব.
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ্।
আমি যদি আপনাকে এ কথা না বলি তাহলে আমার কল্যাণ হবে না। আপনি আল্লাহ্কে ভয় করুন। যে ব্যক্তি আল্লাহ্কে ভয় করে, আল্লাহ্ তার জন্য পথ করে দেন। তার গুনাহ মাফ করে দেন। তাকে বড় প্রতিদান দান করেন। আল্লাহ্ তার নবীকে বলেছেন- ‘হে নবী! আপনি আল্লাহ্কে ভয় করুন। তাদের ও মুনাফিকদের অনুসরণ করবেন না। ‘আল্লাহ্র রাসূল (সা) তাঁর সঙ্গী-সাথীদের ও মু’মিনদের এ নির্দেশ দিয়েছেন। মুসলমানগণ তাঁদের খলিফা এবং নেতৃবৃন্দকেও পরস্পর পরস্পরকে আল্লাহ্কে ভয় করার কথা বলেছেন। আল্লাহ্ কুরআনে বলেছেন- “তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি। তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের কল্যাণে। তোমরা মারুফ কাজের আদেশ দেবে এবং মুনকার কাজের নিষেধ করবে।”
ওয়াসসালাম।
কামাল
আব্দুন নাসেরের কাছে তার সাবেক সহযোগীর এ চিঠি পৌঁছলো। এ চিঠিতে কি বলতে চেয়েছেন তার সাবেক শিক্ষামন্ত্রী, তা বুঝতে বাকি রইলো না। কিন্তু নাসের আল্লাহ্কে ভয় করলেন না। বরং সাবেক শিক্ষামন্ত্রীকে কারাবন্দী করলেন।
কারাগার থেকে সাইয়েদের শেষ চিঠি: সাইয়েদ কুতুব কারাগারে খুবই আনন্দিত। রায় ঘোষণা না হলেও নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড লাভের আনন্দে আনন্দিত। তিনি কারাগারে বসে সাহিত্যিক বন্ধুকে চিঠি লেখেনঃ
ভাই আহমদ,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ্!
আমি তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি যে, তুমি আমার বিশ্বাস ও চিন্তার সাথে একমত। আমি কারাগারে আল্লাহ্কে এমনভাবে পেয়েছি তার আগে কখনও এভাবে পাইনি। আল্লাহ্র বিধানের সাথে যেভাবে পরিচিত হয়েছি অতীতে এভাবে পরিচিত হতে পারিনি। আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট যে, আল্লাহ্ স্বয়ং আমাকে তত্ত্বাবধান করছেন। মু’মিনদের সাথে তার কৃত ওয়াদা পূরণের ব্যাপারে আমার দৃঢ়বিশ্বাস রয়েছে। ইতিপূর্বে এই ধরনের মানসিক প্রশান্তি আমার ছিল না। আমি জানি আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। আল্লাহ্ যা ভালো মনে করেন তাই করবেন। কোন কিছু করার ব্যাপারে তিনিই একমাত্র ক্ষমতার অধিকারী, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা অনুধাবন করতে পারে না।
সাইয়েদ কুতুব একজন কারাপ্রহরীর মাধ্যমে ১৯৬৬ সালের জুলাই মাসে এ চিঠি পাঠান। সাইয়েদের ঈমানী চেতনা কত তীব্র ছিল, এ চিঠির মাধ্যমে তা
ফুটে ওঠে।

রায় ঘোষণা ঃ মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান
আব্দুন নাসেরের সাথে দীর্ঘ আলোচনা করে বিচারক ১৯৬৬ সালের ২১ আগস্ট রায় ঘোষণা করেন। রায়ে অভিযুক্ত ৪৩ জন নেতা-কর্মীর মধ্যে ৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তাঁরা হচ্ছেন সাইয়েদ কুতুব, মুহাম্মদ ইউসুফ, আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাঈল, শবরী আরাফাহ, আহমদ আব্দুল মাজীদ, আব্দুল আযীয, আলী উসমাভী। ২৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ দেয়া হয়। ১১ জনকে দশ থেকে পনের বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। মৃত্যুদ প্রাপ্তদের মধ্যে আলী উসমাভী বিদেশী নাগরিক। কিছুদিন পর তাঁকে মুক্তি দিয়ে আমেরিকা যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। আহমদ আব্দুল মাজীদ, আব্দুল আযীয ও শবরী আরাফাহ্র মৃত্যুদণ্ড হালকা করে যাবজ্জীবন কারাদ দেয়া হয়। সাইয়েদ কুতুবসহ মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্তদের উদ্দেশ্যে রায় ঘোষণাকালে বিচারক বলেন- “হ্যাঁ, তোমাদের নিজেদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক তোমরা সবাই মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাসেরকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছো। তোমরা এদেশের ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতাচ্যুত করতে চেয়েছো। তাই তোমাদের ফাঁসির আদেশ দেয়া হলো।”
মৃত্যুদণ্ডাদেশ শুনে সাইয়েদের প্রতিক্রিয়া: বিচারক সাইয়েদ কুতুবের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণা করার পর আদালতের নথিপত্র যারা লিখেছেন তারা কাঁদছে। অথচ সাইয়েদ রায় শোনার পর খুশি মনে বলে উঠলেন- ‘আলহামদুলিল্লাহ্।’ সেদিন তিনি হাসতে হাসতে বললেন- “আমার কাছে এটা কোন বিষয় নয় যে, আমি কোথায় মরতে যাচ্ছি এবং কিভাবে জালিমরা আমায় মৃত্যুদণ্ড দেবে। আমি তো এতেই সন্তুষ্ট যে, আমি আল্লাহ্র একজন অনুগত বান্দা হিসেবে শাহাদাতের পেয়ালা পান করতে যাচ্ছি।”
যয়নাব আল গাযালী লিখেনে, মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়ার পাঁচ দিন পর সাইয়েদ কুতুব কারাগারে আটক ছোট বোন হামিদা কুতুবকে দেখতে তার কক্ষে যান। সাথে কারাপ্রহরী ইবরাহীম ছিল। কিছুক্ষণ পর ইবরাহীম চলে আসে। তখন ছোট বোন তাঁকে দেখে বললেন- “ধন্যবাদ, প্রিয়ভাই সাইয়েদ। এটা আমার জন্য এক দুর্লভ মুহূর্ত। আপনি আমার পাশে একটু বসুন।”
সাইয়েদ পাশে বসলেন। বিভিন্ন বিষয়ে অনেক আলোচনা হলো। তিনি সবাইকে ধৈর্য ধারণের নির্দেশ দিলেন।
হামিদা কুতুব মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ভাইকে দেখে বিষণœ। সাইয়েদ তাঁর ছোট বোনকে আদর করলেন এবং এমন কিছু কথা বললেন যার পরিপ্রেক্ষিতে হামিদা কুতুবের বিষণœ মনেও হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
মৃত্যুদণ্ডাদেশ মওকুফ করতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অনুরোধ: সাইয়েদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ শোনার পর বিশ্ব নেতৃবৃন্দ হতবাক হয়ে পড়লো। বিচারের নামে অবিচার দেখে মানবতা আর্তনাদ করে উঠলো। মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে সারাবিশ্বে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের ঝড় উঠলো। বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধান ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ রহিত করার জন্য মিসর সরকারের নিকট আবেদন জানানো হয়। বাদশাহ ফয়সাল বিন আব্দুল আযীয তাঁর একজন মন্ত্রীর মাধ্যমে জামাল আব্দুন নাসেরের নিকট পত্র প্রেরণ করেন। মন্ত্রী নাসেরের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলেন। সেখানে আনোয়ার সাদাতও ছিলেন।
নাসের মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘হাতে কি?’
মন্ত্রী জবাব দিলেন- ‘বাদশাহ ফয়সালের বার্তা।’
নাসের জানতে চাইলেন, ‘কি সম্পর্কে?’
মন্ত্রী জবাব দিলেন- ‘সাইয়েদ কুতুব ও তাঁর সঙ্গীদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ রহিত করার জন্য।’
এ কথা শোনার পর নাসের ক্রোধান্বিত হন এবং বাদশাহ ফয়সালের বিশেষ দূতকে শুনিয়ে নির্দেশ দিলেন আগামীকাল খুব সকালে সাইয়েদ কুতুবের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে।
সাইয়েদের সাথে হামিদা কুতুবের শেষ সাক্ষাত: মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়ার পরও সাইয়েদকে বশে আনার জন্য সরকার নানা প্রলোভন দেয়। মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার পূর্ব রাত। একজন কারাপ্রহরী হামিদা কুতুবের রুমে এসে জানায়, আপনাকে কারা তত্ত্বাবধায়ক হামজা বসুনী তার অফিসে দেখা করতে বলেছেন।
হামিদা কুতুব বলেন- আমি তার কক্ষে যাওয়ার পর আমাকে আমার বড় ভাইয়ের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেখানো হয়। অতঃপর কারাতত্ত্বাবধায়ক বলেন, “আমার ভাই যদি তাদের ইচ্ছেমত সবকিছু করতে সম্মত হয় তাহলে মিসর সরকার মৃত্যুদণ্ডাদেশ হালকা করতে প্রস্তুত আছে।” কারাতত্ত্বাবধায়ক আমাকে আরও বলেন, “আমরা জানি আপনি ছাড়া আপনার ভাইকে বুঝাবার অধিক উত্তম ব্যক্তি আর কেউ নেই। আপনার ভাইয়ের কয়েকটি কথা তাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে মুক্তি দিতে পারে। আমি মনে করি আপনি তার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন। আমি এ-ও বিশ্বাস করি যে, আপনারা মিসরের খুবই ভাল মানুষ। আপনারা শুধু আপনাদের বিশ্বাসের বাস্তবায়ানের জন্য কাজ করছেন। আমরা চাই সাইয়েদ মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচুক।” এ কথা বলে কারাতত্ত্বাবধায়ক সাফাত রুবীকে বললেন, হামিদাকে তার ভাইয়ের কাছে নিয়ে যাও। তারপর আমি আমার সহোদর বড় ভাই সাইয়েদ কুতুবের নিকট এলাম। তাঁকে সালাম করলাম এবং তাদের বক্তব্য পৌঁছালাম। তিনি আমার দিকে গভীরভাবে তাকালেন। তারপর বললেন, “তুমি যা বললে, তা কি তুমি চাচ্ছো, না তারা চাচ্ছে? আমি ইশারায় বুঝাতে চেষ্টা করেছি তারা চাচ্ছে। তারপর তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আল্লাহ্র শপথ! যদি এ কথা বলা সঠিক হতো তাহলে আমি বলতাম। দুনিয়ার কোন শক্তি আমাকে একথা বলা থেকে ফেরাতে পারতো না। কিন্তু তারা যা বলছে আমি তা করবো না। আমি কখনোই মিথ্যা বলবো না।”
অতঃপর সাফাত জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি আপনার সিদ্ধান্তের উপর অটল? সাইয়েদ বললেন, হ্যাঁ। এরপর সাফাত আমাদের ছেড়ে চলে গেল। তারপর আমি ভাইয়াকে পুরো ঘটনা বললাম।
ভাইয়া আমাকে প্রশ্ন করলেন, তাদের কথায় তুমি কি সন্তুষ্ট?
আমি বললাম, না।
তারপর ভাইয়া আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, “জীবন ও মৃত্যু আল্লাহ্র হাতে। হায়াত বৃদ্ধি কিংবা কমানোর ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। তারা কারো ক্ষতি কিংবা উপকারের ক্ষমতা রাখে না।”
ইতিপূর্বেও অনুরূপ প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।
একবার সাইয়েদকে প্রশ্ন করা হয় আপনি কেন সুন্দরভাবে তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন? একটু ঘুরিয়ে তাদের কথা স্বীকার করলে মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে রক্ষা পাওয়া যেত।
সাইয়েদ জবাব দেন, আকীদাগত বিষয়ে ‘তাওরিয়া’ জায়িয নেই। কোন আদর্শবাদী সংগঠনের নেতার জন্য রুখসাতের পথ অবলম্বন করা উচিত নয়। আমি পনের বছর শাহাদাত লাভের জন্য কাজ করছি। আল্লাহ্র প্রশংসা, মৃত্যুদণ্ডাদেশ সে সুযোগ এনে দিয়েছে।
সাইয়েদ কুতুবের সাথে হামিদা কুতুবের এটাই ছিল শেষ সাক্ষাৎ। সাইয়েদ আদরের বোনকে শেষবারের মতো দেখে নিলেন। ছোট বোন অশ্র“সজল নয়নে সালাম দিয়ে শেষ বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
বিদায়কালে হামিদাকে বললেন, আমার পক্ষ থেকে মুর্শিদে আম হাসান হুদাইবীকে সালাম পৌঁছাবে।
সাইয়েদ কুতুবের মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর: ২৮ আগস্ট রাতে সাইয়েদ কুতুব, তাঁর সঙ্গী মুহাম্মদ হাওয়াশ ও আব্দুল ফাত্তাহ্ ইসমাঈলকে ফাঁসির সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। কারাগারের চারদিকে সশস্ত্র সৈন্য মোতায়েন করা হয়। তারা টহল দিচ্ছে।
২৯ আগস্ট ভোর রাত। সাইয়েদ কুতুব ও তাঁর দু’সঙ্গীকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ো যাওয়া হচ্ছে। ফাঁসি দেয়ার সকল আয়োজন সম্পন্ন। সাইয়েদ কুতুব ফাঁসির মঞ্চে যাচ্ছেন। তিনি আনন্দিত। তৃপ্তিতে হাসছেন। নির্ভীকচিত্তে পা বাড়াচ্ছেন। সুবহে সাদিকের সময়। চারদিকে ফজরের আযান ধ্বনিত হচ্ছে। সাইয়েদ কুতুব হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে বসলেন।
সাইয়েদ কুতুব ও তাঁর সঙ্গীদের ফাঁসি কার্যকর হলো। কার্যকর করার সংবাদ প্রচারের সাথে সাথে মিসরের মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরা উল্লাস প্রকাশ করে। তারা প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করতে যায়। কিন্তু মিসরের বিভিন্ন কারাগারের কারাবন্দীরা বুকফাটা আর্তনাদ করে। তাঁদের কান্নায় সিক্ত হয় কারাগার। বাদশাহ ফয়সাল মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার খবর শোনার পর পাঠ করলেন- ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিঊন।’ তাঁর দু’চোখ বেয়ে অশ্র“ধারা প্রবাহিত হল। সারা বিশ্বের অগণিত মানুষ কাঁদলো। বিশ্বের সর্বত্রই শোকের ছায়া। সাইয়েদ কুতুব নেই। তিনি আল্লাহ্্র সান্নিধ্যে চলে গেছেন। কিন্তু তাঁর জীবন ও কর্ম বিশ্বের অগণিত মানুষের প্রেরণার উৎস হয়ে রইলো।
এক নজরে সাইয়েদ কুতুবের রচনাবলী: সাইয়েদ কুতুব (র.) ইসলামী আন্দোলনের একজন নেতা। একজন সুসাহিত্যিক ও পণ্ডিত। তিনি তাঁর সাহিত্য জীবন শুরু করেন শিশুসাহিত্য দিয়ে। ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ ও ইসলামী মূল্যবোধ শিশুদের উপযোগী করে সুন্দরভাবে তুলে ধরেন। নবীদের কাহিনী ধারাবাহিকভাবে লেখেন। তিনি শিশুদের জন্য জীবন চরিত, দেশাত্মবোধক গান, ইসলামী গান রচনা করেন। কুরআন চর্চা শুরু করার পর কুরআনের আলোকে সাহিত্য চর্চা করেন, তাফসীর লেখেন। ইসলামী জীবন দর্শনের উপর লেখেন।
তাঁর সাহিত্য কর্মকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
এক. বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে লিখিত প্রবন্ধাবলী। তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় লিখতেন। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা ৪৫৫টি। এ সকল প্রবন্ধাবলী পরবর্তী সময়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
দুই. প্রকাশিত গ্রন্থাবলী। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৬। পঁচিশটি জীবদ্দশায় ছাপা হয়। একটি তাঁর শাহাদাতের বিশ বছর পর প্রকাশিত হয়। তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান অবদান হচ্ছে তাফসীর ‘ফী যিলালিল কুরআন’।
তাঁর লিখিত গ্রন্থাবলী আবার দু’ভাগে বিভক্ত।
ক. সাহিত্য সমালোচনামূলক। এ ধরনের গ্রন্থের সংখ্যা তের।
খ. ইসলামের জীবন দর্শন কেন্দ্রিক। এ ধরনের গ্রন্থের সংখ্যাও তের।
সাইয়েদের প্রসিদ্ধ গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছেÑ
১. মুহীম্মুশ শায়ের ফিলহায়াত ওয়াশশে’র লিজায়লিল হাজির (জীবনে কবির আসল কাজ ও আধুনিক বংশধরদের কবিতা)। এটি তাঁর প্রথম গ্রন্থ। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
২. আসসাতী ওয়াল মাজহুল (কবিতাগুচ্ছ)। ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত হয়।
৩. নকদু কিতাব মুস্তাকবিলিস সাকাফাহ ফি মিসর (মিসরের সংস্কৃতি ভবিষ্যত নামক পুস্তকের সমালোচনা)। ১৯৩৮ সালে লিখিত ডঃ তোহা হুসাইনের মিসরে সংস্কৃতি ভবিষ্যত নামক বইয়ের সমালোচনায় এ বইটি লেখেন।
৪. আততাসবীরুল ফান্নী ফিল কুরআন (কুরআনের শিল্পগত ছবি)। এটিই প্রথম ইসলামী সাহিত্য। ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত হয়।
৫. আলআতইয়াফুল আরবা (চার ভাই-বোনের চিন্তাধারা)। এতে চার ভাই ও বোনের চিন্তা, কল্পনা এবং স্বপ্ন সুন্দরভাবে অংকিত হয়েছে। বইটি ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত হয়।
৬. তিফল মিনাল কারয়াহ (গ্রামের ছেলে)। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত হয়।
৭. মাদীনাতুল মাসহুর (যাদুনগরী)। আসহাবে কাহ্ফ ও আলিফ লায়লার ঘটনা সামনে রেখে এটি লিখিত। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত হয়।
৮. কিতাবুন ওয়া শাখছিয়াতুন (গ্রন্থ ও ব্যক্তিত্ব)। এটিও ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত হয়।
৯. আশওয়াক। ব্যক্তিগত জীবনের কিছু কথা এ বইতে তুলে ধরা হয়েছে। এটি ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয়।
১০. মাশাহিদুল কিয়ামাহ্ ফিল কুরআন (আল-কুরআনে কিয়ামতের দৃশ্য) এ বইতে কুরআনে বর্ণিত জান্নাত, জাহান্নাম, কিয়ামত, হাশর প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। ১৯৪৭ সালে বইটি প্রকাশিত হয়।
১১. রওজাতুত তিফলে (শিশু পার্ক)। এটি শিশুদের জন্য লেখা বিভিন্ন গল্পের সমষ্টি। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয়।
১২. আল কাসাসুদ্দীনী লিল আতফাল (শিশুদের দ্বীনি গল্প)। এতে নবীদের ঘটনা তুলে ধরা হয়। ১৯৪৮ সালে কায়রোর মাকতাবাতু সা‘দ এটি প্রকাশ করে।
১৩. আল জাদিদ ফিল লুগাতিল আরাবিয়াহ।
১৪. আল জাদিদ ফিল মাহ্ফূজা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে থাকার সময় বইটি লেখেন। গ্রন্থটি মিসরের পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
১৫. আননাকদুল আদাব উসুলুহু ওয়া মানাহিজুহু (সাহিত্য সমালোচনার মূলনীতি ও পদ্ধতি) ১৯৪৮ সালের জুন মাসে এটি প্রকাশিত হয়।
১৬. আল আদালুতুল ইজতেমায়ীয়াতু ফিল ইসলাম (ইসলামে সামাজিক সুবিচার)। ১৯৪৮ সালে আমেরিকা যাবার আগে এ বইটি লেখেন। ১৯৪৯ সালে এটি প্রকাশিত হয়।
১৭. তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন।
১৮. মা‘রিকাতুল ইসলাম ওয়ার রাসমালিয়াহ (ইসলাম ও পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব, ১৯৫১ সালে এটি প্রকাশিত।
১৯. আসসালামুল আলামী ওয়াল ইসলাম (বিশ্ব শান্তি ও ইসলাম)। ১৯৫১ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত হয়।
২০. দিরাসাতুল ইসলামিয়া (ইসলামী রচনাবলী)। এটি ৩৫টি প্রবন্ধের সমষ্টি। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয়।
২১. হাযাদ দ্বীন। ১৯৬০ সালে কারাগারে থাকাকালীন লেখেন। এতে কারাগারের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছেন।
২২. আল মুস্তাকবিল লি হাযাদ দ্বীন। মানব রচিত আদর্শের ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী দিনের জীবন ব্যবস্থা হবে ‘ইসলাম’ গ্রন্থটিতে এ কথাই তুলে ধরেছেন।
২৩. খাসায়িসু তাসাব্বুরিল ইসলাম। এ বইতে সৃষ্টিতত্ত্ব, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। এটি ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয়।
২৪. আল ইসলাম ওয়া মুশকিলাতুল হাজারাহ্ (ইসলাম ও আধুনিক সভ্যতার সংকট)। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয়।
২৫. মায়ালিম ফিততারিক। এটি সর্বশেষ গ্রন্থ। ইংরেজিতে গরষবংঃড়হব, বাংলায় ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা নামে প্রকাশিত হয়েছে।
২৬. মুকাওয়ামাতুত তাসাব্বুরিল ইসলামী। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়।
তিন. অপ্রকাশিত গ্রন্থ ও প্রবন্ধাবলী: সাইয়েদ কুতুবের অনেক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ তাঁর কারাবরণের পর হারিয়ে যায়। অনেকগুলো অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠী নষ্ট করে দেয়। এ ধরনের সাহিত্য ও প্রবন্ধের সংখ্যাও অনেক। যেমন- মুহিম্মাতুশ শায়ের ফিল হায়াত, দিরাসাতুল আশওয়াক, কাফিলাতুর রাকিক, হিলমুল ফজর, আল কিসসাতু ফিল আদাবিল আরাবিয়াহ, আল কিসসাতুল হাদীস, আমেরিকা আললাতি রাআইতু, হাযাল কুরআন প্রভৃতি।
তাঁর শাহাদাতের পর বিভিন্ন প্রবন্ধ ও গ্রন্থ থেকে সংকলন করে আরও কিছু গ্রন্থ বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করেছে। যেমন আমেরিকা থাকার সময়ে বন্ধু-বান্ধব ও ভাই-বোনদের কাছে লিখিত চিঠি ‘আফরাহুর রুহ’ নামে প্রকাশিত হয়। নাহবু মুজতা মিয়ুল ইসলামী, মা’রিকাতুনা মায়াল ইয়াহুদ, তাফসীরে
আয়াতের রিবা, আল জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্ প্রভৃতি গ্রন্থ তাঁর শাহাদাতের পর প্রকাশিত হয়।
সাইয়েদ কুতুব মুসলিম বিশ্বের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তিনি শুধু ইসলামী আন্দোলনের নেতা ছিলেন না, তিনি হাফিযে কুরআন, লেখক, প্রখর দ্বীনি জ্ঞানসম্পন্ন আলিম, কবি ও সুসাহিত্যিক হিসেবে সাফল্য অর্জন করেন। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তিনি নজীরবিহীন প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন:
সাইয়েদ কুতুবের শ্রেষ্ঠ অবদান:তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন। সাইদে কুতুব বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। কবিতা, উপন্যাস, গল্প, সাংবাদিকতা, আন্দোলন, সংগঠন সকল ক্ষেত্রেই তিনি অবদান রেখেছেন। তাঁর কোন অবদানকেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ কাব্য ও সাহিত্য চর্চায় তিনি ড. আত্ তোয়াহা হোসাইন, আব্বাস মাহমুদ আলআক্কাদ, তাওফীক হাকিম প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিকদের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। তাঁর কবিতা ও গল্প মিসরের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কাব্য ও সাহিত্য চর্চায় সাইয়েদ কুতুব সফলতা লাভ করলেও বিশ্বব্যাপী তিনি ইসলামী চিন্তাবিদ হিসাবেই অধিক পরিচিত। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান থাকলেও ‘‘তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনই তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান।
তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন সাইয়েদ কুতুবের অমর সৃষ্টি। বিভিন্ন ভাষায় রচিত সমসাময়িক তাফসীরের মধ্যে এটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ তাফসীর। আধুনিক জাহিলিয়াতে নিমজ্জিত আরব-আজমের প্রতিটি মানুষের হৃদয় তন্ত্র—ীতে কুরআনের বাণী পৌঁছে দেয়ার এক অমোঘ তাগিদ রয়েছে এই পুস্তকের পাতায় পাতায়। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি ভাষা তথা ইংরেজি, উর্দু, ফার্সী, তুর্কী, ইন্দোনেশীয়, বাংলা ইত্যাদি ভাষায় এই তাফসীরের অনুবাদ হয়েছে। ফার্সী ভাষায় ‘দার সায়ায়ে কুরআন’ উর্দু ভাষায় ‘কুরআন কে ছায়ে মে’ ইংরেজী ভাষায় ‘ওহ ঃযব ংযধফব ড়ভ অষ-ছঁৎধহ’ বাংলা ভাষায় ‘তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন’ (কুরআনের ছায়াতলে) নামে ২২ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে।১
১১ ও ১২ই মে ২০০০ তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনের বাংলা অনুবাদ প্রকাশনার দু‘দিন ব্যাপী সমাপনী উৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত ‘আলবাছায়ের’ পএিকায় দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিকদের অনেকেই এই তাফসীর সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অভিমত পেশ করেন।
সৈয়দ আলী আহসান২ এ তাফসীর সম্পর্কে বলেন, ‘সাইয়েদ কুতুবের সর্বপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে সমগ্র কুরআন শরীফের একটি বিস্তারিত তাফসীর রচনা করা। এই তাফসীরের নাম ফী যিলালিল কুরআন। সাইয়েদ কুতব লক্ষ্য করেছিলেন যে, সমগ্র বিশ্ব ক্রমশ অন্ধকারের দিকে প্রবেশ করছে। সেখানে পরিচ্ছন্নœতার অভাব, বিশ্বাসের অভাব এবং জ্ঞানের অভাব। মানুষ আল্লাহ্কে স্বীকার করছেনা অথবা বলা যায় আল্লাহ্র সার্বভৌমত্ব মান্য করছেনা। মূলত আল্ল¬াহ্র কর্তৃতে¦র বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ আমরা চতুর্দিকে লক্ষ্য করছি। সে বিদ্রোহ দমন করার জন্য সাইয়েদ কুতুব কলম ধরেছিলেন এবং তাঁর তাফসীরের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ্র সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন।” জনাব শাহ আবাদুল হান্নান৩ বলেন, “আমি যে তিনটি তাফসীরকে বিংশ শতাব্দীতে প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ তাফসীর মনে করি, সেগুলো হচ্ছে আরবীতে ফী যিলালিল কুরআন, মুহাম্মদ আসাদ রচিত ‘দি মেসেজ অব দি কুরআন‘ এবং উর্দুতে সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী রচিত তাফহীমুল কুরআন।” বিশিষ্ট কলামিস্ট আরিফুল হক বলেন,৪ “সমসাময়িক বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক, হাফেয-এ কুরআন, প্রখর ইসলামী জ্ঞানসম্পন্ন সুসাহিত্যিক সাইয়েদ কুতুব শহীদ এর নাম কে না শুনেছে? তাঁর বহু অনন্য সৃষ্টির মধ্যে তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন, ইসলামী চিন্তা জগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী মহাগ্রন্থ। ফী যিলালিল কুরআন অর্থ কুরআনের ছায়াতলে।
এই মহান সাধক, বিপ্ল¬বী, ইসলামী মুজাহিদ সাইয়েদ কুতুবের জীবনের প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতালব্ধ নির্যাস থেকে উৎসারিত এই তাফসীর গ্রন্থ, পৃথিবীর অগণিত তাফসীর গ্রন্থ থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী। এটি ঠিক আর পাঁচটা তাফসীর গ্রন্থের মত মনে হয়না। এই তাফসীর গ্রন্থ পড়লে মনে হয় কুরআনের প্রতিটি আয়াত যেন আমাকে নতুন জীবনের পথে দাওয়াত দিচ্ছে। মনে হয় দুনিয়ার জাহিলিয়াত থেকে আÍরক্ষার উপায় খুঁজে পাচ্ছি, মনে হয় ইসলামের নামে যে ইসলামী দর্শন, চিন্তাধারা, সংস্কৃতি যা প্রচলিত আছে, তার সবটুকু ইসলামসম্মত নয়। মনে হয় এই তাফসীর গ্রন্থ সৃষ্টিকর্তার সাথে সকল মানুষের সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্বাস আরও দৃঢ় করে তুলছে।”
বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী বলেন,৫ “কুরআন কারীমের তাফসীর পৃথিবী ব্যাপী বহু হয়েছে। কিন্তু তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন এক ব্যতিক্রমধর্মী তাফসীর।এর লেখক শহীদ সাইয়েদ কুতুব-তিনি কুরআনের আলোকে নিজের জীবন গড়েছেন। ‘ফী যিলালিল কুরআন’ মানে হচ্ছে ‘কুরআনের ছায়াতলে’। কুরআনের ছায়াতেই তিনি নিজের জীবন কাটিয়েছেন। আল্লাহ্র রাহে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। ফী যিলালিল কুরআন কোন গতানুগতিক তাফসীর নয়। কলমের তুলি দিয়ে এখানে শহীদ কুতুব যা এঁকেছেন, তা আপনার হৃদয়কে আন্দোলিত করবে। আবেগে অভিভূত করে ফেলবে আপনার মনকে। আপনাকে এর আকর্ষণ আকৃষ্ট করে তুলবে।”
কবি আল-মুজাহিদী বলেন৬; “সাইয়েদ কুতুব শহীদ-আজ দুনিয়ার দরোজায় দরোজায় ভেসে থাকা একটি নন্দিত নাম। মানব জাতির মুক্তির সংগ্রামে নিবেদিত উৎসর্গিকৃত সাইয়েদ কুতুবের নাম চির স্মরণীয় হয়েই থাকবে। ‘ফী যিলালিল কুরআন তাঁর অনন্য রচনা। তাঁর এই মহান সৃষ্টি তাঁর স্মৃতিকে কালের ভেলায় তুলে নিয়ে ভেসে যেতে থাকবে- দূরের পথে, অনেক দূরের সীমানায়। পৃথিবী ও পৃথিবীবাসীর কল্যাণের পথে যুগান্তকারী দিশারী হয়ে। আল-কুরআন সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যকার এক অলৌকিক সেতুবন্ধন। প্রতীক ও রূপকের সমন্বয়ে শব্দ ধ্বনি স্বর ও সুরের ব্যঞ্জনার মাধ্যমে এক মহাজীবন আকর সৃষ্টি করেছেন স্রষ্টা তার সৃষ্টিকূলের জন্যে। কুরআনের সেই অনবদ্য সৃষ্টি সম্ভারকে সাইয়েদ কুতুব শহীদ তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন এ তাঁর লালিত্যময় এবং ব্যঞ্জনময় ভাষা শৈলীতে পেশ করেছেন।”
ড. এম মানাযির আহসান বলেন৭, সাইয়েদ কুতুব শহীদের তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন যে কোন ভাষায় সমসাময়িক তাফসীরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ তাফসীরগুলোর অন্যতম হিসাবে স্থান করে নিয়েছে। এই তাফসীরটি কোন গতানুগতিক তাফসীর নয়; বরং তার চেয়ে আরো বেশি কিছু। একে কুরআনের গতিশীল ও বৈপ্ল¬বিক বাণী এবং তার অন্তর্নিহিত অর্থকে তার নিজস্ব চিন্তাধারার মাধ্যমে প্রকাশের এক অক্লান্ত প্রচেষ্টা বলা যায়। এটা শুধু মুসলিম নয়, পুরো মানব জাতিকে কুরআনের ছায়ায় আসার ও তার দ্বারা উপকৃত হবার এক উদাত্ত আহ্বান। এ কারণে এই নামকরণ, তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন বা কুরআনের ছায়াতলে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।”
ডঃ আব্দুল বারী বলেন৮, “সাইয়েদ কুতুব শহীদ আর তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন এক খোদায়ী মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তিনি শৈশব থেকে আল-কুরআনের পরিবেশে মানুষ হয়েছেন, পূরো কুরআন হিফয করেছেন, আত্মস্থ করেছেন।
চিন্তা করেছেন, গবেষণা করেছেন। সংবেদনশীল এবং প্রশান্ত আত্মা নিয়ে মুসলিম জাতির অতীত থেকে শুরু করে তৎকালীন অবস্থার তিনি বিশ্লেষণ করেছেন। জীবনধর্মী শিল্পীর তুলির আচড়ের মত সৃজনশীল কলম ধরেছেন। পাতার পর পাতা ভরেছেন আল্ল¬াহ্র আয়াতের নিদর্শন দিয়ে।”
হাফেয মুনির উদ্দীন আহমদ বলেন৯, “শহীদ সাইয়েদ কুতুব বিংশ শতকের এক কালজয়ী প্রতিভা। তার প্রতিভাদীপ্ত জ্ঞানকোষ থেকে ‘ফী যিলালিল কুরআনে’র পাশাপাশি তিনি আরো কয়টি ইসলামী সাহিত্য রচনা করেছেন। তার প্রতিটি বই যেমনি ইসলামী জ্ঞান-গরিমায় মহীয়ান, তেমনি তা জিহাদের উদ্দীপনায়ও বলীয়ান। তাঁর সাহিত্য যেমনি ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তোলে, তেমনি জেগে থাকা মানুষকে জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। ফী যিলালিল কুরআন এর ব্যতিক্রমধর্মী নাম দিয়েই এই গ্রন্থের বৈশিষ্ট্যের সন্ধান মিলে। এর মানে হচ্ছে কুরআনের ছায়াতলে। ইসলামী জীবন দর্শনের একজন একনিষ্ঠ সাধক তার জীবনের যে দিনগুলো কুরআনের ছায়াতলে কাটিয়েছেন তারই জ্ঞানলব্ধ অভিজ্ঞতা হচ্ছে, ফী যিলালিল কুরআন।”
তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন পৃথিবীর সর্বত্রই সমাদৃত হয়েছে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় এই তাফসীরের উপর অনেক গবেষণা হয়েছে এখনও হচ্ছে। ড. মান্না খলীল ক্কাত্তান তাঁর মাবাহেস ফী উলূমিল কুরআন গ্রন্থে তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ তাফসীর হিসাবে উল্লে¬খ করেছেন।১০ অযসধফ ঝ. গড়ঁংধষষর এ সম্পর্কে বলেন,
ঋর তরষধষ ধষ-ছঁৎধহ রং ছঁঃন’ং রহঃবৎঢ়ৎবঃধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ছঁৎধহ ধং বীঢ়বৎরবহপবফ নু যরস. ঐরং সবঃযড়ফ রং ঁহঁংধষ রহ ঃযধঃ যব রহঃবৎঢ়ৎবঃং ঃযব ছঁৎধহ রহ ঃবৎসং ড়ভ যরং ড়হি ঁহফবৎংঃধহফরহম ধহফ বীঢ়বৎরবহপব. ঞযব ষধহমঁধমব ড়ভ ঃযব রহঃবৎঢ়ৎবঃধঃরড়হ রং ংরসঢ়ষব ধহফ সড়ফবৎহ.১১
আল-কুরআন ও সাইয়েদ কুতুব: তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে আল-কুরআনের সাথে সাইয়েদ কুতুবের সম্পর্ক কিভাবে সৃষ্টি হয়, এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত প্রয়োজন। এ সম্পর্কে সাইয়েদ কুতুব নিজেই বলেন, ‘‘একান্ত শৈশব থেকে আমি আমার মায়ের কাছে কুরআন পড়তে শুরু করি। কুরআনের বিষয়সমূহ এবং গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব ও তথ্যের কিছুই তখন আমি বুঝতামনা। আমার জ্ঞানের পরিধিই বা তখন কতটুকু ছিলো যে, কুরআনের মহান ও জটিল বিষয়সমূহ আমার বুঝে আসবে! কিন্তু মর্ম উদ্ধার করতে না পারলেও কেন যেন শৈশবেই আমি এর একটা প্রভাব সব সময়ই নিজের মনে অনুভব করতাম। কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করার সময় এর বিভিন্ন বিষয়ের ওপর কিছু কিছু কাল্পনিক দৃশ্য আমার সহজ ও সরল মনে অংকিত হয়ে যেতো, যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে নিতান্ত মামুলী ব্যপার বলে মনে হলেও এগুলো আমার অন্তরে কুরআনের প্রতি তীব্র আগ্রহ ও আকর্ষণ সৃষ্টি করতো। আমি অনেকক্ষণ ধরে এসব কাল্পনিক চিত্রে আনন্দ ও উৎসাহের সাথে ডুবে থাকতাম।১২
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, এরপর এলো এমন এক সময় যখন আমি জ্ঞানার্জনের জন্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলাম এবং তাফসীর গ্রন্থসমূহ থেকে কুরআন বুঝার চেষ্টা করলাম। শিক্ষকদের মুখে কুরআনের তাফসীর শুনলাম। কিন্তু কেন যেন এই পড়ায় এবং শোনায় আমি আমার ছোট বেলার সে আনন্দটুকু আর পেলামনা। আফসোস! কুরআনের সৌন্দর্যের সে সব চিহ্ন যেনো একে একে মিটে গেল। আনন্দ ও উৎসাহ থেকে কুরআন যেন খালি হয়ে গেলো, কেনো, আমার কি হলো! একি দুই ধরনের কুরআন? একি আমার সেই শৈশবের সহজ-সাবলীল মিষ্টি-মধুর আনন্দ যোগানোর কুরআন কিংবা এই যৌবনের কুরআন, যা জটিল, প্যাঁচানো এবং বাহ্যিক দৃষ্টিতে অনেকটা খাপছাড়া। ভাবলাম সম্ভবত তাফসীরের ধরন ও স্টাইলের অনুকরণের ফলেই আমার মনে এ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এবার আমি তাফসীরের সাহায্যে বুঝার বদলে স্বয়ং কুরআনকে কুরআন দিয়েই বুঝার চেষ্টা করলাম। কিছুদিন পরই আমি আমার সেই প্রিয় ও প্রাণস্পর্শী কুরআনের সন্ধান আবার পেয়ে গেলাম। কুরআনের সাথে উৎসাহ ও ভালবাসা সৃষ্টি করার সেই আনন্দদায়ক দৃশ্যসমূহের আবার আমি সন্ধান পেয়ে গেলাম। তবে আগের এসব দৃশ্যকে এখন আর সহজ-সরল মনে হয়না। কারণ এখন আমার বোধ শক্তিতে পরিবর্তন এসেছে। এখন আমি এসব আয়াতের মর্মোদ্ধার করতে পারছি, এগুলো হচ্ছে মূলত মানুষের জীবনের কিছু বাস্তব ঘটনার উদাহরণ,যাকে এভাবে পেশ করা হয়েছে,এর সব কয়টির প্রভাব ও আকর্ষণই এখানে স্থায়ী ও অনড়। আলহামদুলিল্ল¬াহ্! আমি আবার কুরআনকে পেয়ে গেলাম। এবার আমি ভাবলাম, এখানে এই নতুন পাওয়া জ্ঞানের নমুনা হিসাবে কয়েকটা আলোচনা লোকদের সামনে পেশ করি। অতঃপর ১৯৩৯ সালে ‘আল-মুকতাতাফ’ ম্যাগাজিনে আমি ‘আত তাস্বীরুল ফান্নী ফিল কুরআন’ শিরোনামে একটা প্রবন্ধ লিখলাম। এতে আমি কুরআন থেকে কয়েকটি ঘঁটনা সম্বলিত চিত্র আঁকতে চেষ্টা করলাম, তার শৌল্পিক সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা পেশ করলাম। পরাক্রমশালী আল্লাহ্তা‘আলার অসীম কুদরতের এমন বর্ণনাও পেশ করলাম, যা শব্দের আবরণে এমন সব চিত্র ও দৃশ্য অংকন করে রেখেছে, কোন আলোকচিত্র শিল্পীর পক্ষেই এর সঠিক অংকন সম্ভব নয়। আমি চিন্তা করে দেখলাম যে, এই প্রবন্ধগুলো তো একটি গোটা
পুস্তকের আলোচ্যসূচী হিসাবে পরিগণিত হতে পারে।১৩
সাইয়েদ কুতুব বলেন, এভাবে আরো কয়েক বছর অতিবাহিত হয়ে গেলো। কুরআনের সেসব দৃশ্য আমার মনে আস্তে আস্তে তৈরী হতে থাকলো। আমি এর সর্বত্র শিল্পের অলৌকিকত্বের সন্ধান পেতে থাকলাম। আর এসব কিছু যখন আমি গভীর ভাবে দেখতাম তখন আমার মনে এই ধারণা পাকাপোক্ত হয়ে যেতো যে,আমি নিজেই এ কাজটার দায়িত্ব গ্রহণ করি এবং একাজটাকে সম্পন্ন করি-যদ্দুর সম্ভব এর পরিধিকে বি¯ৃ‘ত করে দেই। প্রায়ই আমি তখন কুরআন অধ্যয়নে নিমজ্জিত থাকতাম এবং ক্রমেই এর থেকে অমূল্য দৃশ্যসমূহ বের করতে চাইতাম। যতই দিন এগুতে থাকে ততোই আমার অন্তরে এই বিষয়ের উপর কিছু একটা করার ইরাদা পরিপক্ক হতে থাকে। কিন্তু এই ব্যাপারে সময় সময় এমন কিছু বাধা বিপত্তি এসে সামনে দাঁড়াতো যে, এই পরিকল্পনা আমার কাছে অন্তরের একটা আক্ষেপ ও মানসিক উৎসাহ হয়েই থেকে যেতো।
অতঃপর পূরো পাঁচটি বছর কেটে গেলো। পুনরায় ‘আল-মুকতাতাফ’ ম্যাগাজিনে এ সিরিজের প্রথম প্রবন্ধটি প্রকাশ করার সুযোগ হলো আমার। আমি যখন এ আলোচনা শুরু করলাম তখন আমার প্রথম কাজ ছিলো কুরআন থেকে এর শৈল্পিক চিত্রসমূহকে একত্র করা এবং তাকে পাঠকদের কাছে পেশ করা। তাছাড়া এ মহাগ্রন্থের সাহিত্যিক সৌন্দর্য ও রচনাশৈলীর বৈশিষ্ট্যসমূহের বর্ণনা পেশ করা-বিশেষ করে এর সর্বত্র যে নিপুণ শিল্পকলার সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে, তা তুলে ধরা। আলোচ্য নিবন্ধে কুরআনের অন্যান্য আলোচনা ও উদ্দেশ্যসমূহের বিস্তারিত বিবরণ পেশ করা আমার উদ্দেশ্য ছিলনা, বরং আমি যা চেয়েছি তা ছিল এর খাঁটি শৈল্পিক দিকগুলো তুলে ধরা।
কিন্তু এবার আমি কি দেখলাম! আমি যেন এক নতুন সত্যের সন্ধান পেলাম, যা আমার সামনে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। আমি দেখলাম কুরআনে উপস্থাপিত উদাহরণসমূহ তার অন্যন্য বর্ণনা ও অংশ থেকে আলাদা কিছু নয়। এর আলাদা কোনো অবস্থানও নেই বরং কুরআনের বর্ণনা ভঙ্গীটাই হচ্ছে এর সাহিত্যিক দৃশ্য ও চিত্রের নিপুণ অংকন। এ হচ্ছে এমন এক রচনাশৈলী, যাকে শরীয়তের হুকুম-আহকাম বর্ণনা করার বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়সমূহ ব্যাখ্যার জন্যেও ব্যবহার করা হয়েছে। এখন আমার সামনে কুরআনের কতিপয় সাহিত্যিক সৌন্দর্য ও তার নিদর্শনসমূহ একত্রিত ও সংকলিত করার বিষয়টাই প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ালনা, বরং কুরআন ব্যাখ্যার মূলনীতির নতুন পথ উদ্ভাবন করাও আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠলো।১৪
এ প্রসঙ্গে সাইয়েদ কুতুব আরও বলেন, এই তুলনামূলক পর্যালোচনা আমি যখন শেষ করলাম তখন আমি অনুভব করলাম কুরআন এক নতুন রূপে আমার মনে অবতীর্ণ হলো। আমি এমনভাবে কুরআনকে পেলাম যেমন করে ইতোপূর্বে আর কখনো পাইনি। কুরআন আমার অন্তরে এক নতুন সৌন্দর্যের আকার ধারণ করে নিলো অবশ্য আগেও আমার অন্তরে এমন সৌন্দর্যমন্ডিতই ছিলো-তবে তা ছিল বিক্ষিপ্ত ও বিভিন্ন অবস্থায়। আজ তা আমার সামনে একটি সাজানো গোছানো পুস্তুক আকারে উপস্থিত, যা একটি বিশেষ মজবুত বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত-এমন একটি বুনিয়াদ, যাতে আশ্চর্যজনক ও অভূতপূর্ব মিল রয়েছে,যা ইতোপূর্বে আমি কখনও অনুধাবন করতে পারিনি,যার স্বপ্ন ইতোপূর্বে কখনো দেখিনি। সম্ভবত অন্য কোন কল্পনা দিয়েই তা চিন্তা করা সম্ভব নয়। কুরআনের এসব দৃশ্যাবলী ও চিত্রসমূহ উপস্থাপন করতে গিয়ে আমার মানসিক ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-অনুভূতির যথাযথ দাবি আদায় করার ব্যপারে যদি আল্ল¬াহ্ আমাকে তাওফীক দান করেন তাহলে এটাই হবে এই পুস্তকের পূর্ণাঙ্গ সাফল্যের মাপকাঠি।১৫
মূলতঃ তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন হচ্ছে সাইয়েদ কুতুবের সুদীর্ঘকাল ধরে কুরআন অধ্যয়ন ও গবেষণার ফসল।
তিনি কিতাবুল্লাহ্র গভীরে প্রবেশ করে যে মণিমুক্তা আহরণ করেছেন তা পথহারা মানুষগুলোকে পথের দিশা দেবার জন্যে উপস্থাপন করেছেন। তিনি কুরআনের যে স্বাদ পেয়েছেন সে স্বাদ আস্বাদ্বন করার জন্যে বিশ্ব মানবতাকে আহবান জানিয়েছেন।
নামকরণ ও রচনা প্রসঙ্গে: ফী যিলালিল কুরআন মানে কুরআনের ছায়া তলে। সাইয়েদ কুতুব মনে করেন যে কুরআনের ছায়ায় বাস করতে পারা,তার অর্থ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা এবং আল্ল¬াহ্ তা‘আলার এই শেষ কেতাব অনুধাবনের চেষ্টায় লেগে থাকা এমন এক মহামূল্যবান সৌভাগ্যের ব্যাপার-যার অনুধাবন শুধু তিনিই করতে পারেন যিনি তার সময়গুলোকে কুরআন বোঝার কাজে লাগিয়ে রেখেছেন এবং কুরআনের পথে চলে নিজের জীবনকে পূত ও পবিত্র করে রেখেছেন১৬। তিনি সমসাময়িক দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে নিজকে নিজে প্রশ্ন করেন,সমাজে এত প্রজ্ঞা ও সমৃদ্ধ দিকনির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও জীবন কিভাবে এত হতাশা ও অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। তার জবাবে তিনি নিজেই বলেন, আজ মানব জাতির দুর্ভাগ্য ও বদনসীবের মূল কারণ হচ্ছে,তারা আজ তাদের জীবনের সকল কার্যকলাপে বিশ্ব স্রষ্টার দিকে ধাবিত হয়না,আর যতক্ষণ পর্যন্ত তারা আল্লাহ্র দিকে নিবিষ্ট না হবে ততেক্ষন পর্যন্ত তারা এভাবে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াবে এবং এভাবেই তারা দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েই থাকেবে। ইসলামকে উপেক্ষা করা তার বিরুদ্ধাচরণ করা-মানব জাতির ইতিহাসের এমন ভয়াবহতম দুর্ঘটনা,যা গোটা মানব ইতিহাসে দ্বিতীয়বার ঘটেনি১৭। সাইয়েদ কুতুব বলেন, মানুষের চলার জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা যে জীবন বিধান রচনা করেছেন, তা মানবীয় উৎকর্ষের প্রতিটি ধাপে এবং উন্নতির প্রতিটি যুগে সমভাবে উপকারী, মুক্তি ও কল্যাণের ক্ষেত্রে একই ধরনের নিশ্চয়তা বিধানকারী প্রমাণিত হয়েছে। এই জীবন বিধান এমন সব মানুষদের জন্যে যারা এই দুনিয়ায় বসবাস করেন। একারণেই তাতে তার প্রকৃতি, যোগ্যতা ও ক্ষমতার প্রতি পরিপূর্ণ লক্ষ্য রাখা হয়েছে১৮। তিনি দৃঢ়তার সাথেই বলেন, দুনিয়ার মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা, মানবতা কোন রকম শান্তি পেতেই পারেনা,তার ভাগ্যে কোন রকম মানসিক শান্তিই জুটতে পারেনা,কোন ব্যক্তিই উচ্চতা, পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নœতা পেতে পারেনা, সর্বোপরি মানব জাতি কখনো বিশ্বচরাচরের প্রাকৃতিক নিয়মাবলী ও আসমানী নীতিমালা ও বিধিনিষেধের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ আল্লাহ্র দিকে ধাবিত না হবে। আল্লাহ্ তা‘আলার দিকে ধাবিত হওয়ার একমাত্র পন্থা হচ্ছে, আল্লাহ্র নির্ধারিত জীবন ব্যবস্থাকে মানুষ সর্বাংশে গ্রহণ করবে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ্র কিতাব ও তাঁর রাসূল (সা)-এর সুন্নতের কাছ থেকে পথের দিশা নেবে। এই পন্থা ছাড়া সবকিছুই এক একটা ভাংগন-বিপর্যয়, অপবিত্রতা তথা জাহিলিয়াত১৯।
সাইয়েদ কুতুব এই তাফসীরে এ কথা তুলে ধরেছেন যে, যদি কেউ কুরআনের ছায়ায় বাস করতে প্রস্তুত থাকে এবং তার সামর্থ্য অনুযায়ী এর মর্মবাণী আত্মস্থ করতে রাজী থাকে কেবল মাত্র তখনই এর আনুষাঙ্গিক আধ্যাত্মিক সারমর্ম উপলব্ধি করা তার পক্ষে সম্ভব হয়। সাইয়েদ কুতুব নিজে কুরআনের ছায়ায় বাস করেছেন এবং আধুনিক জাহিলিয়াতে নিমজ্জিত পুরো মানব জাতিকে কুরআনের ছায়ায় আসার ও তার দরুন উপকৃত হবার উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন,এই তাফসীরের মাধ্যমে। এ কারণে তাফসীর ‘ফী যিলালিল কুরআন’ বা কুরআনের ছায়াতলে নামকরণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও যথার্থ হয়েছে।
এই তাফসীর গ্রন্থটি তাঁর দীর্ঘদিনের জ্ঞান-গবেষণা ও সাধনার ফসল। ড. সালাহ আব্দুল ফাত্তাহ আল-খালেদী লেখেন, চারটি স্তরে এ তাফসীর গ্রন্থটি লেখা সমাপ্ত হয়২০।
প্রথম স্তর : আলমুসলিমূন পত্রিকায় প্রকাশ
১৯৫১ সালের শেষ দিকে সাইয়েদ রমযান আলী আল-মুসলিমূন পএিকার জন্যে সাইয়েদ কুতুবের কাছে লেখা চান, সাইয়েদ কুতুব আল-কুরআনের তাফসীর লেখার মনস্থ করলেন। সে অনুযায়ী ফী যিলালিল কুরআন (কুরআনের ছায়াতলে) শিরোনামে লেখা শুরু করেন। ১৯৫২ সালের ফেব্র“য়ারী মাসে প্রথম লেখা ছাপা হয়। এর পর আরো সাতটি সংখ্যায় সূরা আল-বাকারার ১০৩ নং আয়াত পর্যন্ত প্রকাশের পর পএিকায় তাফসীর লেখা বন্ধ করে দেন। তৎপরিবর্তে পত্রিকায় নাহবা মুজতামে ইসলামী (ইসলামী সমাজের চিত্র) নামে লেখা দেন২১।

দ্বিতীয় স্তর : পৃথক গ্রন্থাকারে প্রকাশের সূচনা
সাইয়েদ কুতুব উপলব্ধি করলেন যে,ধারাবাহিকভাবে মাসিক পএিকায় তাফসীর প্রকাশ কুরআনের বাণীকে সীমিত সংখ্যক শ্রোতার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য একটা কার্যকরী মাধ্যম,তবুও এটা একটা ধীর পদক্ষেপ এবং তার উদ্দেশ্য অনুযায়ী বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে তা পৌঁছাতে অক্ষম। এ কারণে তিনি তার তাফসীরকে পৃথকভাবে বই আকারে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে এই তাফসীরের প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয় এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে (অক্টোবর ১৯৫২-জানুয়ারী ১৯৫৪) কুরআনের ৩০ পারার মধ্যে ১৪ পারাই খন্ড আকারে প্রকাশিত হয়ে যায়২২।
ড. সালাহ্ খালেদীর মতে এই সময়ের মধ্যে ষোল পারা প্রকাশিত হয়।২৩

তৃতীয় স্তর : কারাগারে সমাপ্তি করণ
১৯৫৪ সালে সাইয়েদ কুতুব গ্রেফতার হন, কারাগারে তাঁর উপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। যার কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে কিছুদিন কারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ফলে এই সময় তাফসীর লেখার প্রতি মনোযোগ দিতে পারেননি। তিনি কিছুটা সুস্থ হয়ে পুনরায় তাফসীর লেখার প্রতি মনোযোগী হন। কিন্তু সরকার কারাগারের ভিতর লেখা-লেখির উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। কারা বন্দীদের জন্য কাগজ কলমের অনুমতি ছিলনা। কারো কাছে এগুলো পাওয়া-শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু সাইয়েদ পেরেশান ছিলেন তাফসীর লেখার জন্য। সে সময় তিনি পূর্ণাঙ্গ তাফসীর প্রকাশের জন্য দার এহ্ইয়া আল-কুতুব আল-আরাবিয়্যার সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। প্রকাশক লেখালেখির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্ষতিপূরণ দাবী করে সরকারের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করলে আদালত লেখালেখির অনুমতি দান করে।এর পর সাইয়েদ কুতুবের লেখালেখির কাজ আবার শুরু হয়। সরকারের পক্ষ থেকে শেখ মুহাম্মদ গাযালীকে ফী যিলালিল কুরআনের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করা হয়। তিনি দেখে দেয়ার পর তা ছাপা হতো। সাইয়েদ গাযালী সূরা আল-বুরূজের কিছু অংশ তাফসীর থেকে বাদ দেন, সেগুলো পরবর্তীতে ‘মায়ালিম ফিততারিক’ গ্রন্থে ‘হাযা হুয়াত্তারিক’ শিরোনামে ছাপা হয়২৪।
কারাগার থেকে তাফসীর লেখা ও প্রকাশের কারণে জামাল আব্দুন্নাসের বিভিন্ন স্থানে সাইয়েদ কুতুব সম্পর্কে প্রশ্নের সম্মুখীন হলে জবাব দিত, সাইয়েদ কুতুব কারাগারে আটক নেই, তার প্রমাণ হচ্ছে কায়রো থেকে প্রকাশিত তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন। জামাল নাসের পাকিস্তান সফরে গেলে পাকিস্তানী আলিমদের প্রশ্নের উত্তরেও অনরূপ জবাব দেন২৫।

চতুর্থ স্তর : নতুন আঙ্গিকে পুনরায় লেখার সূচনা
কারাগারে তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন লেখা সমাপ্তের পর সাইয়েদ কুতুব নতুন আঙ্গিকে কুরআনের তত্ত্ব ও মহত্ব উদঘাটনের চেষ্টা করেন। এ দৃষ্টিভঙ্গীতেই শেষ তিন পারা লেখেন। ১৯৬৪ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাবার পর একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ পারা লেখেন এবং আশা করেছিলেন এভাবেই পূরো কুরআন শরীফের তাফসীর নতুন আঙ্গিকে লেখবেন। কিন্তু তাঁর সে আশা পূরণ হলোনা। ১৯৬৫ সালে তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয় এবং ১৯৬৬ সালে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া হয়২৬।
সাইয়েদ কুতুবের শাহাদাতের পর লেবাননের একটা প্রকাশনা সংস্থা বৈধ অনুমতি ছাড়া আট খন্ডে তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন প্রকাশ করে। কিন্তু সাইয়েদ কুতুবের ছোট ভাই মুহাম্মদ কুতুবের অনুমতি নিয়ে বৈরুতের ‘দার আশ্ শুরুক’ ছয় খন্ডে তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন প্রকাশ করে২৭। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ২৮তম সংস্করণ প্রকাশিত হয়২৮।
কুরআন ব্যাখ্যার পদ্ধতি: আল-কুরআন অবতীর্ণের সমসাময়িক কালে আরবে যে সব কাফির ও মুশরিক ছিলো, তারা এর সৌন্দর্য ও শৈল্পিক বিন্যাসে আকৃষ্ট হয়ে কখনো এই কুরআনকে কাব্য আবার কখনো একে যাদু বলে আখ্যায়িত করতো। কিন্তু এ ব্যাপারে বলিষ্ঠভাবে তারাও বলতে পারেনি যে, শৈল্পিক সৌন্দর্য মন্ডিত এ বস্তুটি কি? সাইয়েদ কুতুব তাঁর তাফসীরে কুরআনের শিল্প ও সৌন্দর্য কেন এত মনোহর তাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
ইমাম আব্দুহু আল-কুরআনের তাফসীরের ক্ষেত্রে আযহারী ওলামাদের প্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ করেননি, কুরআনের শাব্দিক বিশ্লে¬ষণের পরিবর্তে তার শৈল্পিক রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। আল্ল¬ামা রশীদ রিযা কর্তৃক রচিত তাফসীর আল-মানার ও শাইখ আহমদ মোস্তফা মারাগীর তাফসীরে সেই ধারা অনুসরণ করা হয়েছে২৯। সাইয়েদ কুতুব তাঁর তাফসীরে সেই একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। তবে আব্দুহুর তাফসীর ও সাইয়েদ কুতুবের তাফসীরের মধ্যে বিভিন্ন কারণে পার্থক্য বিদ্যমান, সে সম্পর্কে পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে।
তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনে অনুসৃত কুরআন ব্যাখ্যার পদ্ধতি সম্পর্কে ড. মানাযির আহসান বলেন, মওদূদী সাহেবের মত সাইয়েদ কুতুবও কুরআনের অধিকাংশ সূরায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লিখেছেন। তিনি সূরার মূল বাণীর গভীরে গিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে অথচ এত দক্ষতার সাথে তা পেশ করেছেন, যার ফলে একজন নতুন পাঠকের মনে হয় যেন কেউ কুরআন বোঝার দরজাটা খুলে তার সামনে মেলে ধরেছেন। তাছাড়া কুরআনের বাণীকে ভালভাবে বোঝার জন্য তিনি এর অধ্যায়কে শিক্ষামূলক ও বিষয়বস্তু ভিত্তিক ভাগ করেছেন এবং সূরার শুরু ও শেষের সাথে যোগসূত্র তুলে ধরার মাধ্যমে তার কাজকে অন্য সকলের কাজ থেকে আলাদা করে ফেলেছেন। এভাবে তিনি সূরার গঠনগত সাদৃশ্য ও বাণীসমূহের পরস্পর যোগসুত্র তুলে ধরেছেন৩০।
এ প্রসঙ্গে অযসধফ ঝ.গড়ঁংধষষর বলেন: ঞযব ষধহমঁধমব ড়ভ ঃযব রহঃবৎঢ়ৎবঃধঃরড়হ রং ংরসঢ়ষব ধহফ সড়ফবৎহ. ঊাবৎু ংঁৎধয (পযধঢ়ঃবৎ) যধং ধহ রহঃৎড়ফঁপঃরড়হ ধহফ ধ পড়হপষঁংরড়হ ঃযধঃ ফৎধি ঃযব ঃযবসবং ড়ভ ঃযব ংঁৎধয রহঃড় ড়হব ঢ়রপঃঁৎব. ঐরং সবঃযড়ফ রং পড়সঢ়ৎবযবহংরাব রহ ঃযব ংবহংব ঃযধঃ যব ঃঁৎহং ঃযব ংঁৎধয ড়ৎ ধুধয (াবৎংব) বাবৎু ধিু রহ ড়ৎফবৎ ঃড় ভরহফ ধষষ ড়ভ ঃযব ঢ়ড়ংংরনষব সবধহরহমং ৎবষধঃরহম ঃড় হধঃঁৎব, ঢ়ড়ষরঃরপং, ৎবধষরঃু ধহফ ংড় ভড়ৎঃয. ঞযরং ধিং ফড়হব রহংঃবধফ ড়ভ ঃযব ঃৎধফরঃরড়হধষ সবঃযড়ফ ড়ভ রহফঁষমরহম রহ ষবমধষ ফরংঢ়ঁঃবং, ষরমঁরংঃরপ ফরভভবৎবহপবং ধহফ হরপবঃরবং. গড়ৎবড়াবৎ, যব রং াবৎু সঁপয রহঃবৎবংঃবফ রহ ংযড়রিহম ঃযব ঢ়ংুপযড়ষড়মরপধষ ঢ়ৎড়ঃড়ঃুঢ়বং ড়ভ ভধরঃয, নবষরবভ, ঃযব মড়ড়ফ, ঃযব বারষ, রহভরফবষরঃু ধহফ ঃৎরবং ঃড় ৎবষধঃব ঃযবংব ঃড় যঁসধহ হধঃঁৎব ধহফ ঃযব যধৎসড়হু নবঃবিবহ সধহ, ঃযব ঁহরাবৎংব, ধহফ এড়ফ.৩১
সাইয়েদ কুতুব তাঁর ‘আততাসবীরুল ফান্নী ফিল কুরআন’ গ্রন্থে আল-কুরআনের তাফসীর সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আল-কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার পরবর্তী যুগের দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি,তবে দেখতে পাই,সাহাবা কেরাম বিভিন্ন রিওয়াতের মাধ্যমে কুরআনের অনেক জায়গার তাফসীর করেছেন,যা কুরআনের বিষয় ও ভাষ্য সংক্রান্ত সরাসরি রাসূল (সা) কর্তৃক বর্ণিত। সাহাবাদের মধ্যে অনেকে খুব ভয়ে ভয়ে কিছু আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন, আবার অনেকে কুরআনের ব্যাখ্যাকে গুনাহর কাজ মনে করে ব্যাখ্যা বিশ্লে¬ষণ থেকে দূরে থাকতেন। এমনকি সাঈদ ইব্ন মুসাইয়্যেব সম্পর্কে কথিত আছে যে, তাঁর নিকট কুরআনের কোন অংশের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলতেনঃ আমি কুরআনের ব্যাখ্যা সম্পর্কে কিছু বলতে চাইনা। এজন্য তাদের সময় কুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লে¬ষণ কাংখিত মানে পৌঁছতে পারেনি। যখন সাহাবাদের যুগের পর তাবেয়ীদের যুগ এলো, তখন তাফসীরশাস্ত্র আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি লাভ করলো। তবে তার ধরন ছিলো, কোনো আয়াতের তাফসীর অনুরূপ কোনো বাক্য বা শব্দ দিয়েই তারা সম্পাদন করতেন। হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষ দিকে তাফসীর শাস্ত্রের বিস্তৃতি ঘটে। কিন্তু কুরআনের শিল্প ও সৌন্দর্য এবং তার তাৎপর্য বর্ণনার পরিবর্তে সেখানে ইতিহাস, ব্যাকরণ, দর্শন ও তর্কশাস্ত্রের বিষয়বস্তু প্রধান্য লাভ করে। এভাবে তারা লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে পড়ে। মুতাআখ্খিরীনদের মধ্যে আল্ল¬ামা যামাখশারী এ ব্যাপারে কিছুটা অগ্রসর হয়েছেন। তবুও বলা যায় যামাখশারী এ কাজে পরিপূর্ণ সফলতা লাভ করতে পারেননি৩২।
সাইয়েদ কুতুব বলেন, বালাগাত, কুরআনের অলৌকিকত্ব নিয়ে বিতর্ক করার উলামা এখনও আছে। আশা করা হয়েছিলো হয়তো এদিকে তাফসীরকারগণ অগ্রসর হয়ে গেছেন এবং কুরআনের শৈল্পিক বিন্যাস ও তার সৌন্দর্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদানের সামর্থ্য তারা রাখেন। কিন্তু তারা শুধু নিজেদেরকে অনর্থক তর্ক-বিতর্কেই নিয়োজিত রেখেছেন। যেমন বালাগাত কি শব্দের মধ্যে না অর্থের মধ্যে পাওয়া যাবে, এ নিয়ে বিতর্ক। সাইয়েদ কুতুব আরও বলেন, বালাগাত ও কুরআনের অলৌকিকত্বের প্রবক্তা উলামাদের মধ্যে একজন আল্ল¬ামা যামাখশারীর পূর্বসূরী ছিলেন। তিনি হচ্ছেন আব্দুল কাহের জুরজানী। তাঁর রচিত দালায়েলুল ‘ইজায-গোটা পুস্তকটিই আল-কুরআনের শব্দ ও অর্থ সংক্রান্ত বক্তব্যে ভরপুর। যা থেকে সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করা অত্যন্ত কষ্টকর৩৩।
সাইয়েদ কুতুবের মতে, এ পর্যন্ত কুরআনের তাফসীর ও অলৌকিকত্ব সম্পর্কে উলামাগণ যে সমস্ত খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন তা নির্দিষ্ট এক সীমায় এসে থেমে গেছে। আল-কুরআনের বালাগাত নিয়ে যে সমস্ত উলামায়ে কেরাম তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হতেন, তারা কুরআনের একক বৈশিষ্ট্যকে বিতর্কের বিষয়বস্তু বানিয়েছিলেন কিন্তু তারা কুরআনের সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহের ধারে কাছেও পৌঁছতে পারেননি। সাইয়েদ কুতুব মনে করেন, এ মহা গ্রন্থের মধ্যে যে উঁচু স্তরের শিল্পকলা বিদ্যমান তা কোন অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং গোটা গ্রন্থেই তা সমভাবে বিদ্যমান। তাঁর মতে কুরআন মাজীদের সমস্ত বর্ণনার মধ্যেই একটি অদৃশ্য সম্পর্ক বিদ্যমান৩৪।
সাইয়েদ কুতুব তাঁর তাফসীরে তাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সাইয়েদ কুতুবের কুরআন ব্যাখ্যার পদ্ধতি সম্পর্কে
খবড়হধৎফ ইরহফবৎ বলেন; উবংঢ়রঃব ঃযব ভধপঃ ঃযধঃ ছঁঃন বীঢ়ষরপরঃষু ভধঁষঃং ঃযব ঃৎধফরহরড়হধষ পড়সসবহঃধঃড়ৎং ভড়ৎ ভধরষরহম ঃড় ঢ়ৎড়ফঁপব ধ পড়সঢ়ৎবযবহংরাব ধবংঃযবঃরপ ঃযবড়ৎু ড়ভ ঃযব ছঁৎধহ, রঃ ংববসং ঃড় সব ঃযধঃ যব ফড়বং হড়ঃ ফড় ংড় বরঃযবৎ. ঐব পড়সবং সঁপয পষড়ংবৎ ঃড় ঢ়ৎড়ারফরহম ধ পড়সঢ়ৎবযবহংরাব পড়সসবহঃধৎু ড়হ ঃযব ছঁৎধহ ডযরপয রং রহভড়ৎসবফ নু যরং ঃড়ি নধংরপ ঢ়ৎরহপরঢ়ষবং (ঃযধঃ ঃযব সবঃযড়ফ ড়ভ ঃযব ছঁৎধহ রং ধৎঃরংঃরপ ধহফ ঃযধঃ রং ধৎঃ রং ধহ রহঃবমৎধঃবফ যিড়ষব) নঁঃ যব ফরফ হড়ঃ ঢ়ৎড়ফঁপব ধ ঃযবড়ৎু ড়ভ ধৎঃ রঃংবষভ.৩৫
তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সাইয়েদ কুতুব কুরআন ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে নিুবর্ণিত (গবঃযড়ফ) পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন;
১. ভূমিকায় গোটা সূরা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা: সাইয়েদ কুতুব কুরআনের তাফসীর শুরু করার আগে সংক্ষিপ্তাকারে গোটা সূরার মৌলিক আলোচ্য বিষয় প্রত্যেক সূরার শুরুতে উল্যে¬খ করেছেন। এ প্রসঙ্গে ঝড়ষরযরহ বলেন.; ইবভড়ৎব পড়সসবহপরহম ঃযব বীবমবংরং, ছঁঃন ঢ়রপশবফ ংবাবৎধষ ঃযবসবং যিরপয ংযড়ি শবু ধংঢ়বপঃং,ঃড় মরাব ধ পড়সঢ়ৎবযবহংরাব ঁহফবৎংঃধহফরহম ড়ভ ঃযব সবংংধমব ড়ভ ঃযব ংঁৎধয.৩৬ উক্ত ভূমিকা অধ্যয়ন করার পর তাফসীর পড়লে সহজেই হৃদয়ঙ্গম করা যায়। উদাহরণ স্বরূপ সূরা আল-বাকারার ভূমিকা থেকে সাইয়েদ কুতুবের কয়েকটি উদ্ধৃতি পেশ করছি। সাইয়েদ কুতুব ভূমিকার এক জায়গায় বলেন, যে ব্যক্তি কুরআনের ছায়াতলে জীবন যাপন করে সে কুরআনের প্রতিটি সূরার মধ্যে এক একটা অনন্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে থাকে। সে অনুভব করে যেন প্রত্যেক সূরার একটা সজীব ও প্রাণবন্ত সত্ত্বা রয়েছে যা হৃদয়ের লালন ও বিকাশে সহযোগীর ভূমিকা পালন করে থাকে। সে আরো লক্ষ্য করে যে, প্রত্যেক সূরার একটা অথবা একাধিক আলোচ্য বিষয় রয়েছে যা একটা সুনির্দিষ্ট কেন্দ্রীয় বিষয়ের সাথে সংযুক্ত। তাছাড়া প্রত্যেকটা সূরার এক একটা বিশেষ পটভূমি রয়েছে। সূরার আলোচিত সব কটি বিষয় সেই পটভূমির আওতাধীন থাকে। অতঃপর কতিপয় সুনির্দিষ্ট দিক থেকে সেই বিষয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধিত হয়। এক একটা ছন্দগত সুর ব্যঞ্জনা প্রত্যেক সূরায় লক্ষ্যণীয়৩৭।
সাইয়েদ কুতুবের মতে, সূরা বাকারায় বেশ কয়েকটি বিষয় আলোচিত হয়েছে। তবে একটি মাত্র কেন্দ্রীয় বিষয় এসব কয়টি আলোচ্য বিষয়কেই সংযুক্ত করেছে। আলোচনার দুটো প্রধান ধারা এই কেন্দ্রীয় বিষয়ের জন্য গভীরভাবে সন্নিবেশিত ও সন্মিলিত হয়েছে। এই দুটো প্রধান ধারার একটি হলো মদীনায় অবস্থিত ও প্রচলিত ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে বনী ইসরাঈলের বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গী এবং রাসূলুল্ল¬াহ্ সাল্ল¬াল্ল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬াম পরিচালিত ইসলামী আন্দোলন ও গড়ে উঠা ইসলামী সংগঠনের বিরুদ্ধাচরণ। আলোচনার দ্বিতীয় ধারাটা ইসলামী সংগঠনের আবির্ভাবের সূচনাকালীন অবস্থা এবং মু’মিনদেরকে পৃথিবীতে ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার গুরু দায়িত্ব পালনের যোগ্য করে গড়ে তোলাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। এর আগেই সূরা বাকারায় এ দায়িত্ব পালনে বনী ইসরাঈল তথা ইহুদী-খ্রিষ্টান জাতিদ্বয়ের ব্যর্থতা, এ ব্যপারে তাদের পক্ষ থেকে আল্লাহ্র কাছে দেয়া অঙ্গীকার ভঙ্গ এবং আদি ও আসল তওহীদের নিশানবাহী হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের প্রকৃত ও যথার্থ বংশধর হওয়ার গৌরব ও অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। আর যে সব ভ্রান্ত কার্যকলাপের জন্য বণী ইসরাঈল এত বড় গৌরব থেকে বঞ্চিত হয়েছে, সেগুলো থেকে সংযত ও নিবৃত্ত থাকার জন্য মুসলিম জনগণকে সাবধান করা হয়েছে। এ দুটো প্রধান ধারার সমন্বয়ে ও সংযোগে গঠিত হয়েছে সূরা বাকারার কেন্দ্রীয় বক্তব্য৩৮।
সূরা বাকারার উক্ত কেন্দ্রীয় বক্তব্যের সাথে তার আলোচ্য বিষয়গুলোর এবং মদীনার প্রথম ইসলামী আন্দোলনের সাথে ইসলামী সংগঠনের জীবনধারা ও তার বাধা-বিপত্তিগুলো যে কত গভীরভাবে সম্পৃক্ত ও কিরূপ ওতোপ্রোতভাবে জড়িত সেটা স্পষ্ট করার জন্য সাইয়েদ কুতুব এ বাধা বিপত্তির উপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করেছেন।
তিনি বলেন, রাসূলুল্ল¬াহ্ সাল্ল¬াল্ল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬ামের মদীনায় হিজরত কোন অপ্রত্যাশিত ও আকস্মিক ঘটনা ছিলনা। ইসলামী আন্দোলনকে যে খাতে প্রবাহিত করার পরিকল্পনা আল্লাহ্ দিয়েছিলেন, তার জন্য এটা ছিল একটি
অত্যাবশ্যকীয় পদক্ষেপ। রাসূলের অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক আবূ তালিব এবং হযরত খাদীজা (রা)-এর ইন্তিকালের পর মক্কার ইসলামী আন্দোলনের প্রতি কুরাইশদের আক্রোশ ও বিদ্বেষমূলক আচরণ মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এ আচরণ এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিল যে, মক্কায় ও তার আশে পাশে ইসলামী আন্দোলনের কাজ প্রায় বন্ধই করে দিতে হয়েছিল। এসব কারণে রাসুলুল¬াহ (সা) তাঁর দাওয়াতের কাজ পরিচালনার জন্য মক্কা ছাড়া অন্য কোন ঘাঁটির সন্ধানে ব্যাপৃত ছিলেন। ইসলামী আন্দোলন পরিচালনার ঘাঁটি হিসাবে মদীনাকে বেছে নেয়ার আগে আরো কয়েক জায়গায় হিজরত করা হয়েছিল। হিজরত করা হয়েছিল আবিসিনিয়ায়। অনুরূপভাবে রাসূলের তায়েফ গমন ও ইসলামী আন্দোলন পরিচালনার একটা স্বাধীন অথবা কমপক্ষে একটা নিরাপদ ঘাঁটি সন্ধানের উদ্দেশ্যেই সংঘটিত হয়েছিল বলে মনে হয়৩৯।
সাইয়েদ কুতুব বলেন, প্রথম হিজরতকারী ও হিজরতকারীদের প্রথম সাদর অভ্যর্থনাকারী এই সব মু’মিনদের সমন্বয়ে মুসলমানদের সেই দলটি গঠিত হলো, কুরআন বহু জায়গায় যাদের উচ্চ কণ্ঠে প্রশংসা করেছে। এখানে আমরা দেখতে পাই সূরা বাকারা ঈমানের বৈশিষ্ট্যসমূহের বিবরণ দিয়েই শুরু হয়েছে। এসব বৈশিষ্ট্য খাঁটি মু’মিনদের পরিচায়ক, তা যে সময়ের ও স্থানের হোকনা কেন। কিন্তুমু’মিনদের যে দলটি ঐ সময় মদীনায় উপস্থিত ছিল এই সূরায় বিশেষভাবে তাদের বর্ণনাই প্রথমে দেয়া হয়েছে। এর অব্যহিত পরেই দেখতে পাই কাফিরদের গুণ-বৈশিষ্ট্যের বিবরণ। এগুলো সাধারণভাবে কুফরীর চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আলোচ্য সূরায় প্রত্যক্ষভাবে সেই কাফিরদেরই বিবরণ দেয়া হয়েছে, যারা তখন ইসলামী আন্দোলনের মুখোমুখি অবস্থান করছিল। এমনিভাবে সেখানে মুনাফিক তথা বর্ণচোরা মুসলমানদের একটা দল ছিল।
যে পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে রাসূলকে মদীনায় হিজরত করতে হয়েছিল এবং মদীনায় তখন যে অবস্থা বিরাজমান ছিল সেই সামগ্রিক পরিস্থিতিই মুনাফিকদের উদ্ভবের কারণ ছিল৪০।৪১
সাইয়েদ কুতুব এইভাবে বিভিন্ন সূরার শুরুতে সূরার কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন।
২. সূরাকে অধ্যায় ভিত্তিক বিভক্ত করা: সাইয়েদ কুতুব তাঁর তাফসীরে এক একটি সূরাকে কয়েকটি অধ্যায়ে ভাগ করেন। যেমন সূরা বাকারার ১-২৯ নম্বর আয়াত এক ভাগে,৩০-৩৯ এবং ৪০-৭৪ নম্বর আয়াত পৃথক পৃথক অধ্যায়ে তাফসীর করেন। এভাবে পূরো সূরার তাফসীরে অনেকগুলো আয়াতকে এক এক অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করেন৪২।
৩. সূরাকে বিষয়বস্তু ভিত্তিক ভাগ করা: কুরআনের বাণীকে ভালভাবে বুঝার জন্য সাইয়েদ কুতুব একই অধ্যায়কে আবার বিষয়বস্তু ভিত্তিক ভাগ করেছেন। যেমন সূরা বাকারার চার নম্বর রুকুর ৩০-৩৯ আয়াতের তাফসীরে আদম (আঃ) এর সুষ্টি ও খেলাফত প্রসঙ্গে প্রথম আলোকপাত করেছেন। এর পর মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেষ্ঠত্বের কথা তুলে ধরেছেন। অতঃপর আদম (আঃ) এর দুর্লভ সম্মান, পদস্খলন, তাওবা, ইবলীসের অহংকার ও চূড়ান্ত পতন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন৪৩।
৪. অধ্যায় শেষে উপসংহার: সাইয়েদ কুতুব প্রত্যেক অধ্যায়ের তাফসীর শেষে আরেক অধ্যায়ের তাফসীর শুরুর আগে সংক্ষিপ্ত উপসংহার টেনেছেন। যেমন সূরা বাকারার ১-২৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর শেষে তিনি লিখেছেন,এভাবে সূরার প্রথম পর্ব শেষ হলো।এর পুরোটাই ঈমান এবং পরহেযগার মু’মিনদের পদাংক অনুসরণ ও তাঁদের দলভুক্ত হবার দাওয়াতে কেন্দ্রীভূত৪৪।
৫. বিষয়বস্তুর সুসঙ্গতি: সাইয়েদ কুতুব একই অধ্যায়ে অনেক বিষয়ে আলোচনা করেছেন,কিন্তু পূর্বাপর সুসঙ্গতি রেখেই পৃথক বিষয়বস্তু তুলে ধরেছেন। পাঠক অধ্যয়নের সময় তাফসীরের মধ্যে ধারাবাহিকতা খুঁজে পান।
৬. অধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত আলোচনা: সাইয়েদ কুতুব তাফসীর শুরুর আগে অধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন। যেমন সূরা বাকারার ১-২৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর শুরুর পূর্বে সাইয়েদ কুতুব লেখেন, ১-২৯ নম্বর আয়াত তথা প্রথম তিন রুকূ জুড়ে বিস্তৃত এই অংশ কুরআনের এই বিশালকায় ও সর্ববৃহৎ সূরার সূচনা পর্ব। ইহুদীরা ছাড়া অন্য যে সব গোত্র মদীনার ইসলামী আন্দোলনের পক্ষে স্থান নিয়েছিল এ আয়াতগুলোতে আমরা তাদের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। এভাবে তিনি অধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা শেষে লেখেন,সূরা বাকারার প্রথম তিন রুকূর প্রধান প্রধান বক্তব্যের এই হলো সংক্ষিপ্ত সার। এবার আমরা এই সংক্ষিপ্ত সারকে একটু বিশদভাবে আলোচনা করার প্রয়াস পাবো৪৫।
৭. পূর্বাপর যোগসূত্র: সাইয়েদ কুতুব একটি সূরার সাথে আরেকটি সূরার, একটি অধ্যায়ের সাথে আরেকটি অধ্যায়ের চমৎকার যোগসূত্র তুল ধরে তাফসীর করেছেন। যেমন সূরা বাকারার ৭৫-১০৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর করার সময় উল্লে¬খ করেন,সূরার পূর্ববর্তী অংশে বনী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ্ তা‘আলার অনুগ্রহ এবং সেই অব্যাহত অনুগ্রহের প্রতি তাদের অস্বীকৃতি ও নাশোকরীর বিবরণ দেয়া হয়েছে। এই অনুগ্রহ বিতরণ ও তার অস্বীকৃতির কিছু দৃশ্যও তুলে ধরা হয়েছে। সে সবের কোনটা ছিল সংক্ষিপ্ত ,কোনটা বিস্তৃত। সর্বশেষ বলা হয়েছে যে,তাদের এই অপকর্মের দরুন তাদের মন নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা ও অনুর্বতায় পাথরকেও ছাড়িয়ে গেছে৪৬।
৮. একাধিক অভিমতের ক্ষেত্রে সাইয়েদ কুতুবের নিকট গ্রহণযোগ্য মতের উল্লে¬খ: যে সকল ক্ষেত্রে একাধিক অভিমত রয়েছে, সে ক্ষেত্রে সাইয়েদ কুতুব তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য মত কোন্টি, তা উল্লেখ করেছেন। যেমন, সূরা ফাতিহার তাফসীরের সময় উল্লেখ করেছেন, বিসমিল্ল¬াহির রাহমানির রাহীম নিয়ে মতবিরোধ আছে। কেউ বলেছেন এটি সূরা ফাতিহার অন্তর্ভুক্ত, আবার কেউ বলেছেন সামগ্রিকভাবে এটি কুরআন শরীফের এমনি একটি আয়াত। প্রতিটি সূরাই এ দিয়ে শুরু করা হয়েছে। সর্বাধিক পরিমাণ সত্য হচ্ছে এটি সূরা ফাতিহারই অন্তর্ভুক্ত৪৭। এভাবে তিনি সূরা বাকারার তাফসীরের শুরুতে উল্লেখ করেছেন, আলিফ, লাম, মীম; এই তিনটি হরুফে মুকাত্তায়া অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন অক্ষর দ্বারা সূরাটির সূচনা হয়েছে। আর এর অব্যবহিত পরই আল্লাহ্র কিতাব সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ এই সেই কিতাব, যাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই, যা খোদাভীরুদের জন্য পথনির্দেশিকা। কুরআনের কয়েকটি সূরায় এ ধরণের বিক্ষিপ্ত বর্ণমালার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এর ব্যাখ্যা নানাভাবে করা হয়েছে। তন্মধ্যে আমি একটি ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করি, সেটি এই যে,এ দ্ধারা ইংগিতে এ কথাই বলা হয়েছে যে, এই গ্রন্থ এই সব বর্ণমালা দিয়েই লিখিত, যা আরব শ্রোতাদের নাগালের মধ্যে বিদ্যমান। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি এমন এক অলৌকিক গ্রন্থ, যার সমতুল্য কোন গ্রন্থ এই একই বর্ণমালা দিয়ে রচনা করতে সক্ষম নয়। এই গ্রন্থ তাদেরকে বারংবার চ্যালেঞ্জ দিয়েছে যে,এর মত দশটি সূরা বা নিদেন পক্ষে একটি সূরাই রচনা করে আন। কিন্তু তারা এই চ্যালেঞ্জের কোন জবাব পর্যন্ত দিতে পারেনি৪৮।
৮. গ্রহণযোগ্য সূত্র থেকে উদ্ধৃতি: সাইয়েদ কুতুব তাঁর তাফসীরে গ্রহণযোগ্য সূত্র থেকেই উদ্ধৃতি দিয়েছেন। কুরআন, হাদীস ও অন্যান্য তাফসীর থেকেই তিনি উদ্ধৃতি দিয়েছেন৪৯। এ প্রসঙ্গে সাইয়েদ কুতুব নিজেই বলেন, কুরআনে করীমের ব্যাখ্যার জন্য পাশ্চাত্যের জ্ঞানগর্ব দার্শনিকদের কাছে আমাদের যাওয়ার দরকার নেই। তারা তো কুরআনের অদ্ভূত ও বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা দিয়ে মূলত আমাদেরকে কুরআন থেকেই দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছে৫০। কোন কোন তাফসীরে প্রাচীন আরবী কবিতার যে ধরনের ব্যাপক উদ্ধৃতি লক্ষ্য করা যায়, সাইয়েদ কুতুব তাঁর তাফসীরে আরবী কবিতার সে ধরনের ব্যাপক উদ্ধৃতি দেয়া থেকে বিরত ছিলেন। তবে কখনও কখনও আরবী কবিতার উদ্ধৃতিও তাঁর তাফসীরে পাওয়া যায়, যেমন সূরা আল-হুযরাতের তাফসীরের এক জায়গায় তিনি আরবী কবিতা থেকে উদ্ধতি দিয়েছেন।
৯. দার্শনিক বিতর্ক এড়িয়ে চলা: তিনি অপ্রয়োজনীয় আইনগত তর্কবিতর্ক সযতেœ এড়িয়ে গেছেন এবং বিভিন্ন দার্শনিক চিন্তাধারার পক্ষে বিপক্ষের যুক্তিগুলোকেও আলোচনায় আনেননি। তার মূল লক্ষ্যই ছিল রাসূল (স) ও তাঁর সাহাবী এবং তার সমসাময়িক আলিমগণ যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, সে ভাবেই কুরআনের বাণীকে উপস্থাপন করা৫১।
১০. ফিক্হ শাস্ত্রের গভীর পর্যালোচনা না করা: সাইয়েদ কুতুব বিশেষ প্রয়োজন ব্যতিরেকে আলোচনায় ফিকাহ শাস্ত্রের গভীর অনুসন্ধান বা ব্যবহার শাস্ত্রের বিশদ পর্যালোচনা করেননি। যেখানে প্রয়োজন ফিকহী বিষয়ে সকল ইমামের মত উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব ইজতিহাদী মতও দিয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপ সূরা বাকারার ২২৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর উল্লেখ করা যায়। তিনি উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেন, আয়াতে যে ‘ছালাছাতা কুরু’ শব্দটি রয়েছে, তার অর্থ নির্ণয়ে মতভেদ রয়েছে,কারো মতে এর অর্থ তিনটি ঋতুকাল, আবার কারো মতে তিনটি ঋতুুমুক্ত পবিত্রতা কাল। সাইয়েদ কুতুব ‘নারীদের উপর পুরুষের মর্যাদা আছে’ অংশের ব্যাখ্যায় নিজের ইজতিহাদী অভিমত উল্লেখ করে বলেন, আমার মতে, কুরআনের এই উক্তিতে স্ত্রীকে ইদ্দতকালে স্বামীর তত্ত্বাবধানে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। এই অধিকার স্বামীকে দেয়ার কারণ এই যে, স্বামীই তালাক দিয়েছে। স্বামী তালাক দেবে আর প্রত্যাহারের অধিকার দেয়া হবে স্ত্রীকে এবং সে গিয়ে স্বামীকে নিজের তত্ত্বাবধানে নেবে-এটা যুক্তিসঙ্গত নয়। বস্তুত স্বামীর এই অগ্রাধিকার পরিস্থিতির দাবি। এটা শুধু ইদ্দতকালের সীমিত অধিকার। এটা কোন শর্তহীন ও সীমাহীন অধিকার নয় যেমন অনেকে মনে করে থাকে এবং অন্যান্য স্থানেও উদাহরণ হিসাবে পেশ করে থাকে৫২।
১১. শাব্দিক বিশ্লেষণ বেশি না করা: সাইয়েদ কুতুব তাঁর তাফসীরে শাব্দিক
বিশ্লে¬ষণ বেশি করেননি। কোথাও কোথাও এধরনের বিশ্লে¬ষণ দেখা গেলেও তা মূলত আয়াতের ভাব ফুটিয়ে তোলার জন্যই করেছেন। যেমন সূরা আল-ইনফিতার এর এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, আবরার শব্দটি ‘বার’ শব্দের বহুবচন এবং এই শব্দটি সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যে নেক কাজ করতে করতে সেটি তার সার্বক্ষণিক ও চিরস্থায়ী স্বভাব ও অভ্যাসে পরিণত হয়। আর সৎকর্ম বা পূণ্যকর্ম বলতে যে কোন ভাল কাজকেই বুঝায়। এর সাথে যে বিশ্লেষণ যুক্ত হয়,সেটা ঐ ভাল কাজের প্রভাবাধীনেই মানবতা ও মহত্বের সাথে সমন্বিত রূপ লাভ করে৫৩। অনুরূপভাবে সূরা আল-বুরূজের তাফসীরের এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, মাজীদ শব্দের অর্থ হচ্ছে উন্নত, মহান, গৌরবময়। সুতরাং আল্লাহ্র কথার চেয়ে উন্নত, মহৎ ও গৌরবময় কথা আর কারো নেই। এটি রয়েছে সংরক্ষিত স্থানে। সেটি কেমন আমরা জানতে পারিনা। কেননা এটি অদৃশ্য জ্ঞানের আওতাভূক্ত যা আল্লাহ্ ছাড়া আর কারোই জানা নেই। আমরা কেবল ওহীকৃত বচনের কিছু ভাব ও ইংগিতটুকুই বুঝতে পারি৫৪।
১২. আল্লাহ্র সিফাত সংক্রান্ত মুতাসাবিহা আয়াত বা শব্দের বিশ্লে¬ষণ থেকে বিরত থাকা: কুরআনের যে সব আয়াত বা শব্দের ব্যাখ্যায় রাসূল (সা) ইংগিত বা বিস্তারিত কিছু বলেননি, সেখানে তিনি অন্যান্য মুফাসসিরদের মত নিজস্ব বিবেচনার উপর ভিত্তি করে কল্পনার আশ্রয় অথবা রায় প্রদান বা মতামত ব্যক্ত করা, এর কোনটাই করেননি৫৫। এ প্রসঙ্গে ঝড়ষরযরহ বলেন, ডরঃয ৎবমধৎফ ঃড় াবৎংবং ঢ়বৎঃধরহরহম ঃড় ঃযব ধঃঃৎরনঁঃবং ড়ভ এড়ফ, ংঁপয ধং ুধফঁষ-ষষধয, ধিলযঁ-ষষধয. ডযরপয ষরঃবৎধষষু সবধহং ঃযব যধহফ ধহফ ভধপব ড়ভ এড়ফ, ছঁঃন ফড়বং হড়ঃ ঢ়ঁঃ সঁপয বসঢ়যধংরং ড়হ ঃযব ষরঃবৎধষ ধংঢ়বপঃ, হড়ৎসধষষু ফবনধঃবফ নু ঃযব বধৎষু বীবমবঃবং যিড় ফরংপঁংং ঃযব াধৎরড়ঁং ারবংি ড়ভ ফরভভবৎবহঃ ংপযড়ড়ষং ড়ভ ঃযড়ঁমযঃ.৫৬
১৩. কোন কোন শব্দের ব্যাখ্যার পরিবর্তে কুরআনের সুস্পষ্ট অর্থকেই গ্রহণ: যে সব ক্ষেত্রে কুরআনের আয়াত থেকে শাব্দিক অর্থ ছাড়া বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি, সে ক্ষেত্রে সাইয়েদ কুতুব কুরআনের সুস্পষ্ট অর্থকেই গ্রহণ করেছেন। যেমন- আরশ সংক্রান্ত শব্দের ব্যাখ্যায় তিনি কুরআনের সুস্পষ্ট অর্থের বাইরে কিছু বলেননি। এ প্রসঙ্গে ঝড়ষরযরহ বলেন; অষ-অৎংয (ঞযব ঃযৎড়হব),গঁংষরসবং ধৎব ংরসঢ়ষু ধংশবফ ঃড় নবষরবাব ধং ঃযবু ড়িঁষফ হড়ঃ শহড়ি রঃং ৎবধষরঃু.টহষরশব অষ-ওংঃরবধি যিরপয ষরঃবৎধষষু সবধহং ংঃধু রঃ পধহ নব ংধরফ ঃড় নব ধহ ধষষবমড়ৎরপধষ যবমবসড়হু ড়াবৎ যরং পৎবধঃরড়হ.৫৭
১৪. আসবাবে নুযূলের উল্লে¬খ: সাইয়েদ কুতুব তাঁর তাফসীরের কোথাও কোথাও আসবাবে নযুলের উল্লেখ করেছেন। যেমন সূরা আল-হুজরাতের প্রথম আয়াতে আসবাবে নযুলের উল্লেখ আছে।
ফী যিলালিল কুরআনের উৎসমূল: কেউ কেউ বলেন, তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনে তাফসীরের চেয়ে সাইয়েদ কুতুবের কল্পনার প্রকাশই বেশি ঘটেছে। আবার কারো কারো মতে, ফি যিলালিল কুরআনের ব্যাখ্যার চেয়ে ইসলামী সমাজ ও জীবন ব্যবস্থার চিত্রই ফুটে উঠেছে৫৮। মূলত তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনে সাইয়েদ কুতুব মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের সত্যিকার মেসেজ তুলে ধরেছেন। কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লে¬ষণের ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও তাঁর ইজতিহাদী অভিমত পেশ করলেও তা ছিল কুরআন-হাদীস ও অন্যান্য তাফসীরকারদের গ্রহণযোগ্য মতামতের ভিত্তিতে। তিনি এই গ্রন্থে মৌলিকভাবে নিু বর্ণিত সূত্র থেকেই তথ্য নিয়েছেন।
১. মহাগ্রন্থ আল-কুরআন: সাইয়েদ কুতুব কুরআন দিয়েই কুরআন বোঝার চেষ্টা করেছেন। তিনি কুরআনের আলোকেই কুরআনের ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ সূরা আল-বাকারার ২৬ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা পেশ করা যায়। তিনি মুনাফিকদের সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে উল্লেখ করেন, পবিত্র কুরআনে মুনাফিকদের জন্য আল্লাহ্ তায়ালা একাধিক উদাহরণ দিয়েছেন। তারা সেই বক্তির মত, যে আগুন জ্বালানোর আকাংখা পোষণ করেছিল এবং আকাশ থেকে নামা দুর্যোগের মত, যাতে অন্ধকার, বিজলী ও বজ্রপাতের সন্মিলন ঘটেছে। এ উদাহরণ ইহুদী ও মুশরিকদের সাথেও হয়ত মিলে যেত। ইতোপূর্বে মক্কী সূরাগুলোতেও এ ধরনের উদাহরণ নাযিল হয়েছিল এবং তা মদীনায়ও পড়া হতো। যেমন কাফিরদের মাকড়সার সাথে তুলনা করা হয়েছে ঃ তারা মাকড়সার মতো, যে নিজের জন্য বাসস্থান তৈরী করেছে। আর মাকড়সার বাসা দুর্বলতম বাসাই; যদি তারা জানত। অন্যত্র কাফিরদের দেব দেবীকে মাছি পর্যন্ত সৃষ্টি করতে অক্ষম বলে উল্লেখ করেছেন, যেমনঃ আল্লাহ্ ছাড়া আর যাদেরকে তোমরা ডাকো,তারা সবাই মিলিত হয়েও একটা মাছি বানাতে পারবেনা। আর মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নেয় তবে তারা তা তার কাছ থেকে ফিরিয়ে নিতেও পারবেনা। প্রার্থী ও প্রার্থিত উভয়ই দুর্বল।
মুনাফিকরা উক্ত উদাহরণাবলী দেখে নাক সিটকাতো এবং এ দ্ধারা মানুষের মনে কুরআনের সত্যতা ও ওহীর ভিত্তি সম্পর্কে সন্দেহের জাল বিস্তারের চেষ্টা চালাতো। তারা যুক্তি দিত যে,তাদেরকে হেয় প্রতিপন্নকারী ও বিদ্রƒপকারী এসব উদাহরণ আল্লাহ্র কাছ থেকে আসেনি এবং আল্লাহ্ তার কিতাবে মাছি ও মাকড়সা ইত্যাদির মত তুচ্ছ প্রাণীর উল্লেখ করেননা। এ ছিল মক্কায় মুশরিকদের এবং মদীনায় ইহুদী ও মুনাফিকদের সন্দেহ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পরিচালিত অপপ্রচারের অংশ বিশেষ। এই ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারের দাঁতভাঙ্গা জবাব নিয়ে এসেছিল এই আয়াতটি৫৯। তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন ভালভাবে অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, সাইয়েদ কুতুব একটি আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বিভিন্ন আয়াত উল্লেখ করেছেন।
২. হাদীসে রাসূল সাল্ল¬াল্ল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬াম: সাইয়েদ কুতুব তাফসীর করতে গিয়ে হাদীস থেকে অনেক উদ্ধৃতি দিয়েছেন। আল্ল¬ামা আলভী আসসাক্কাফ তাঁর ‘তাখরীজ আহাদীস ফী যিলালিল কুরআন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, সাইয়েদ কুতুব ফী যিলালিল কুরআনে ৯৩৩টি হাদীস উল্লেখ করেছেন৬০। আসসাক্কাফ লেখেন, কুরআনের ৩৫ টি সূরা ছাড়া অন্য সকল সূরার তাফসীরে হাদীসের উল্লেখ আছে। যে সব সূরার তাফসীরে সাইয়েদ কুতুব কোন হাদীস উল্লেখ করেননি,সে সব সূরা হচ্ছে;
১. সূরা ইউসুফ ২. সূরা ইবরাহীম ৩. আল-হিজর ৪. সূরা ত্বাহা ৫. আল-হাজ্জ ৬. আস্ সাজদা ৭. সূরা ইয়াসীন ৮. আস্ সাফফাত ৯. আয্ যুমার ১০. আল-জাসিয়া ১১. র্আ রাহমান ১২. আল-ওয়াক্কিয়া ১৩. সূরা নূহ ১৪. আল-ইনসান ১৫. আল-মুরসালাত ১৬. আন্ নাবা ১৭. আত্ তাক্ভীর ১৮. আল-ইনফিতার ১৯. আল-বুরুজ ২০. আত্ তারেক ২১. আল-বালাদ ২২. আশ্-শাম্ছ ২৩. আল-লাইল ২৪. আদদোহা ২৫. আশ শরহ ২৬. আল-বাইয়েনাহ ২৭. আলযিলযাল ২৮. আল-আদিয়াত ২৯. আল-ক্কারিয়া ৩০. আত্ তাকাসূর ৩১. আল-হুমাযাহ ৩২. সূরা কুরাইশ ৩৩. আল-মাউন ৩৪. আল-কাফেরুন ৩৫. আন্ নাস।
আসসাক্কাফ অনেক পরিশ্রম করে তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন থেকে সকল হাদীস সংকলন করেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ফী যিলালিল কুরআনে হজরত ‘আয়েশার ১৭টি, আব্দুল¬াহ্ ইব্ন আব্বাসের ৪০টি, আব্দুল্ল¬াহ্ ইব্ন ওমর বিন খাত্তাবের ৬টি, আব্দুল্লাহ ইব্ন মাসউদের ১০টি, আলী ইব্ন আবি তালিবের ৭টি, ওমর ইব্ন খাত্তাবের ২৬টি, আবূ হুরায়রার ৩টি, আবূ বকর সিদ্দীকের ১১টিসহ মোট ৫২ জন সাহাবীর আছার রয়েছে৬১।
৩. প্রাচীন ও আধুনিক সমসাময়িক গ্রহণযোগ্য তাফসীর : সাইয়েদ কুতুব কোন কোন প্রসঙ্গে প্রাচীন ও সমসাময়িক অন্যন্য গ্রহণযোগ্য তাফসীর থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। অতঃপর নিজস্ব অভিমত পেশ করেছেন। তিনি সূরা বাকারার ২৭৪-২৭৯ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় সুদ সম্পর্কে বিভিন্ন মুফাসসিরের অভিমত তুলে ধরেন। যেমন:
সাইয়েদ কুতুব উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় এক জায়গায় উল্লেখ করেন, ইমাম রাযী তাঁর রচিত তাফসীরে বলেছেনঃ রিবা আন-নাসিয়া সাধারণভাবে আরব সমাজে পরিচিত ছিল। এভাবে বিভিন্ন জায়গায় ইমাম রাযীর অভিমত উল্লেখ করেছেন। সাইয়েদ কুতুব আবূ বকর আল-জাসসাসের অভিমতও উল্লেখ করেন। তিনি সুদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য বিদগ্ধ আলিম ও এ বিষয়ের সুপন্ডিত মরহুম
উস্তাদ সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর -সূদ , ইসলাম ও আধুনিক অর্থনৈতিক মতবাদ বইটি পড়ার জন্য পাঠককে পরামর্শ দেন৬২। সূরা বাকারার ১৮৭ নম্বরও আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইব্ন জারীর তাবারী ও ইব্ন কাসীর এর তাফসীর থেকে উদ্ধৃতি দেন৬৩। এভাবে বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্ল¬ামা রশীদ রিযা, আব্দুহু, আলূসী, ইব্ন আরাবী, সুয়ূতী, কুরতুবী, জাসসাস, যামাখশারী, বাগভী, সা‘লাভী প্রমুখের তাফসীর থেকে উদ্ধৃতি পেশ করেন।
৪. পাশ্চাত্যের মনীষীদের গ্রন্থ: সাইয়েদ কুতুব তাঁর তাফসীরের কোথাও কোথাও পাশ্চাত্যের মনীষীদের গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন,তবে তাঁদের মত গ্রহণ করে নয়, বরং তীব্র সমালোচনা করে৬৪।
৫. ইসলামী চিন্তাবিদ ও ঐতিহাসিকদের উদ্ধৃতি: তিনি কোথাও কোথাও ইতিহাস ও মুসলিম বিশ্বের পরিচিত ইসলামী চিন্তাবিদদের গ্রন্থ থেকেও উদ্ধৃতি দিয়েছেন। যেমন সূরা আল-আসর এর তাফসীরের এক জায়গায় সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ)র মুসলিম জাতির অধঃপতনে বিশ্বের কি ক্ষতি হয়েছে‘ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দেন৬৫।
তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনের বৈশিষ্ট্য: সাইয়েদ কুতুব বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন,তাঁর প্রতিভাদীপ্ত জ্ঞানকোষ থেকে লিখিত ‘ফী যিলালিল কুরআন’ সত্যিই অভূতপূর্ব এক তাফসীর। অতীতের সব কয়টি সেরা তাফসীর গ্রন্থের পাশাপাশি এটি নিসঃন্দেহে আমাদের তাফসীর সাহিত্যে এক অমূল্য সংযোজন। এ তাফসীর গ্রন্থটি অনেক বিশেষণে বিশেষিত, নতুন ধারা ও পদ্ধতিতে লিখিত। নিুে এ তাফসীর গ্রন্থের কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো;
১.সাবলীল ও পরিমার্জিত সাহিত্যিক ভাবধারা: সাইয়েদ কুতুব আরবী সাহিত্যের অন্যতম সেরা সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক ছিলেন। তিনি তাঁর তাফসীরের শব্দ চয়ন,বাক্য বিন্যাস ও উপস্থাপনায় কুরআনের শিল্প ও সৌন্দর্যের প্রতি লক্ষ্য রেখেছেন। কুরআন যে সময় নাযিল হয়,তখন আরবী সাহিত্যের উৎকর্ষের যুগ ছিল। কিন্তু কুরআনের সাহিত্য মানের কাছে তা নিষ্প্রভ প্রমাণিত হয়।
এতে প্রমাণিত হয় যে, কুরআন হচ্ছে সব সাহিত্যের সেরা সাহিত্য, কুরআনের সাহিত্যমান তুলনা করার মত কোন সাহিত্য আজ পর্যন্ত রচিত হয়নি, ভবিষ্যতেও কারো পক্ষে রচনা করা সম্ভব হবে না। সাইয়েদ কুতুব একজন সাহিত্যিক হিসাবে কুরআনের মাঝে সাহিত্যের খোরাক খুঁজে পেয়েছেন। আর কুরআনের রূপ ও সৌন্দর্য চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনে। এ প্রসঙ্গে ড. মানাযির আহসান বলেন, ‘‘সাইয়েদ কুতুব সাবলীল ও পরিমার্জিত সাহিত্যিক ভাবধারায় কুরআনের ব্যাখ্যা এত আধুনিক ও গতি শীতলভাবে তুলে ধরেছেন, যা পাঠককে তার মন মানসিকতার গভীরে নিয়ে যায়। ফলে তিনি ইসলামকে দুনিয়ার বুকে জীবন্ত একটি সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে কঠোর সংগ্রামে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে উদ্ধুদ্ধ হন এবং কুরআনের ছায়ায় প্রবেশ করে এর আশির্বাদপুষ্ট কতিপয় ব্যক্তির ভিতর নিজেকে শামিল করতে সক্ষম হন”৬৬।
ওবায়েদুল্লাহ ফালাহী বলেন, সাইয়েদ কুতুব যে বিষয়েই কলম ধরেছেন তা এক উঁচু মানের সাহিত্য, রাজনৈতিক, সামাজিক, দ্বীনি বা ফিক্হী সব ধরনের লেখাতেই সাহিত্য রস খুঁজে পাওয়া যায়। কুরআনের তাফসীরে তিনি একথা ফুটিয়ে তুলেছেন যে, কুরআন একটা মুজিযা, এর সমকক্ষ কোন কিছু রচনা করতে মানুষ অক্ষম৬৭।
সাইয়েদ কুতুব কুরআনের তাফসীর করতে গিয়ে কুরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্য যেমন চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন তা অন্য তাফসীরে তেমনভাবে পাওয়া যায়না। উদাহরণ স্বরূপ সূরা আদ দুহা থেকে সাইয়েদ কুতুবের তাফসীরের কিছু অংশ উল্লেখ করছিঃ
সাইয়েদ কুতুব বলেন, এ সূরার ছত্রে ছত্রে বর্ণিত কথাগুলোর মধ্যে যেন দয়া-মায়া-মমতা ও গভীর ভালবাসার এক মধুর আমেজ রয়েছে, যা বান্দাহর পরম ও চরম কাম্য। নিগৃহীত, নির্যাতিত,সমাজ পরিত্যক্ত রাসূলের ঐ মুহূর্তে ঐ মধুমাখা বাণীর প্রয়োজন ছিল। যার আগমন মুহূর্তে বুকভরা তাঁর বেদনারাশি ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে গেল। পাহাড়সম নিষ্ঠূর বোঝা যেন অকস্মাৎ তাঁর দুটি নাযুক কাঁধ থেকে নেমে গিয়ে তাঁকে মুক্ত করে দিল।
এ ভালবাসা ভীতি আনয়নকারী নয়, নয় এটা কোন নতুন অথবা বিভিন্ন কিছু। আলোচ্য সূরার মাধ্যমে এ ভালবাসারই বার্তা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এই ভালবাসাই সকল শান্তির মূল। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সেতুবন্ধন। আর সৃষ্টির সকল কিছুর মধ্যে, বিশেষ করে মানুষে মানুষে এ ভালবাসার বন্ধন মজবুত হোক এটাই আল্লাহ্ পাক সূরাটির প্রথমে বলতে চেয়েছেন। এই ভালবাসার কারণে মানুষে মানুষে সম্পর্ক সুশীতল হবে, হবে মানুষ সুখী-সমৃদ্ধশালী৬৮।
অনরূপভাবে সূরা আশ্ শাম্সের তাফসীরে এক জায়গায় সাইয়েদ কুতুব উল্লেখ করেছেন, আর চাঁদ এর পিছনে পিছনে আসে বলতে বুঝানো হয়েছে যে, যখন এই চাঁদ সূর্যকে অনুসরণ করে এবং তার পিছনে মৃদু আলো নিয়ে এগিয়ে এসে পৃথিবীকে øিগ্ধতা ও সোনালী আভায় ভরে তোলে। চাঁদের সাথে মানুষের মনের গভীর ভালবাসা বহু প্রাচীনকাল থেকে কিংবদন্তীর মত প্রচলিত আছে। এ ভালবাসা মানব মনের গভীরে গ্রথিত। চাঁদের এ আলো মানুষের মনের গভীরে বরাবরই প্রেম-ভালবাসার আবেগ জাগায়। চাঁদনী রাতে মনের মাঝে কোন প্রেয়সী যেন ফিসফিসিয়ে তার প্রেমের বার্তা ছড়িয়ে হৃদয় মনকে উজ্জীবিত করে তোলে। মনে হয় সব কিছু প্রিয়তম স্রষ্টার প্রেমে বিভোর হয়ে তাঁর তাসবীহ জপতে শুরু করে। কবি মন এ মধুর জোৎøালোতে যেন এক সুমধুর সুরের লহরী শুনতে পায়। এই চাঁদনী রাতে প্রেমিক মন আল্লাহ্ পাকের মহব্বতের সুধা পান করে তাঁর প্রেমগাঁথা গাইতে গাইতে মুগ্ধ আবেগে আত্মহারা হয়ে যায়,বিধৌত হয়ে যায় তার কলুষিত মন। জোৎøার øিগ্ধ আলোতে অবগাহন করে প্রেমাষ্পদ আল্লাহ্ তা‘আলার আলিংগনে নিজকে সঁপে আল্লাহ্র পাগলরা পরম পরিতৃপ্তির নিশ্বাস ছাড়ে৬৯। তাফসীরের এই যে সাহিত্যিক উপস্থাপনা, তা সত্যিই অনন্য।
২. ইসরাঈলিয়াত মুক্ত: সাইয়েদ কুতুবের এই তাফসীরের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি ইসরাঈলিয়াত নামে পরিচিত বাইবেলের বিষয়বস্তুর উপর বিশ্বাস করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত ছিলেন। অনেক প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থেও ইসরাঈলী বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন, তাফসীরে জালালাইন, লেবানন দার আল-মারেফা থেকে প্রকাশিত তাফসীর জালালাইনের শুরুতে অধ্যাপক মারওয়ান সারওয়ার জালালাইন থেকে ২১টি আয়াত উল্লেখ করে তুলে ধরেছেন যে, সেখানে ইসরাঈলী ভিত্তিহীন বর্ণনা রয়েছে৭০। তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনে এই ধরনের কোন বর্ণনা না থাকায় পাঠক কুরআনের ব্যাখ্যা সেই ভাবে পড়ছেন, যে ভাবে আল্লাহ্র রাসূল (স), আসহাবে রাসুল (স) এবং অন্যান্য ওলামায়ে কেরাম ব্যাখ্যা করেছেন। এভাবে তিনি তাঁর তাফসীরে ইসরাঈলী বর্ণনা সযতেœ এড়িয়ে গেছেন।
৩. জটিল শব্দের চমৎকার ব্যাখ্যা: সাইয়েদ কুতুব জটিল শব্দের চমৎকার ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। যেমন প্রাচীন অনেক তাফসীরে সূরা আল-ইনশিরাহ্ এর দুই নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় ‘বিয্র’ শব্দের অর্থ গুনাহ উল্লেখ করা হয়েছে। সাইয়েদ কুতুব বলেন, এটা রাসূল (সা) এর শানের খেলাফ৭১। সাইয়েদ কুতুব এই ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন; আর আমি (মহান আল্লাহ্) তোমার থেকে তোমার বোঝা নামিয়ে দিয়েছি, যা তোমার পিঠকে ভেংগে দিচ্ছিল। তোমার ব্যর্থ প্রচেষ্টা তোমার পিঠের উপর দুর্বিসহ এক বোঝারূপে অনুভূত হচ্ছিল, যার ভারে তোমার পিঠ ভেংগে যাচ্ছিল। সেই সময় তোমার অন্তর প্রশস্ত করে দিয়ে আমি (মহান আল্লাহ্) তোমার সে বোঝাকে তোমার থেকে নামিয়ে দিলাম। আর তখন তুমি হালকা বোধ করতে লাগলে, তোমার যোগ্যতাকে বাড়িয়ে দিলাম,দাওয়াত দানের পথটি সহজ করে দিলাম,মানুষের অন্তরে তোমার কথাকে গ্রহণযোগ্য করে তুললাম। আর এমন সব কথা ওহীরূপে পাঠালাম, যা সত্য প্রকাশে সফলতা অর্জন করল এবং তোমার কথাকে মানুষের মধ্যে প্রভাবপূর্ণ করে দিল, সহজ ও সাবলীল ভাষার মাধ্যমে তা গ্রহণযোগ্য ও বোধগম্য করে দিল ৭২। সাইয়েদ কুতুব এখানে ‘বিয্র’ শব্দের অর্থ চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন।
৪. সংশোধন, সংযোজন ও পুনঃর্বিবেচনা: সাইয়েদ কুতুব একজন উঁচুমানের গবেষক ছিলেন, তিনি কুরআনের ব্যাখ্যা লিখতে গিয়ে উপলব্ধি করতেন যে, এটাঁ এত ব্যাপক ও বৈচিত্রে ভরপুর যে, তার নিজের লেখাই বারবার পুনঃবিবেচনা, সংশোধন, সম্পাদনা ও সংযোজনের প্রয়োজন হয়। তিনি এক আয়াতের তাফসীরের পর অন্য আয়াত বা এক সূরার তাফসীরের পর অন্য সূরার তাফসীর করা কালে যখন উপলব্ধি করতেন যে, তাঁর পূর্বের ব্যাখ্যার সংশোধন বা সংযোজন প্রয়োজন আছে, তখন টীকা লেখে বা পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করে নিতেন৭৩। তিনি জটিল বিষয়ে পাঠকদের কাছ থেকেও অভিমত কামনা করেছেন।
যেমন সূরা বাকারার এক জায়গায় তিনি লেখেছেন,আমি ছয় মাস চিন্তা করেছি, নামায সংক্রান্ত এই আয়াত তালাকের আলোচনার মাঝখানে কিভাবে এসেছে। আমার আশা ছিল এই সময়ের মধ্যে আল্লাহ্ আমার দিলে বাস্তব রহস্য উন্মোচন করে দিবেন, কিন্তু এখনও সঠিক তত্ত্ব আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি। পাঠকদের কেউ যদি এই বিষয়ে আমাকে অবহিত করেন, তাহলে আমি কৃতজ্ঞ থাকবো৭৪।
আমি এই উদ্ধৃতি ‘সাইয়েদ কুতুব : হায়াত ও খিদমত’ বই থেকে দিয়েছি। আমার কাছে আরবী ও বাংলায় ফী যিলালিল কুরআনের যে কপি আছে, এতে সূরা বাকারা ২৩৭ নম্বর আয়াতের সুস্পষ্ট যোগসূত্র উল্লেখ আছে। আমার কাছে মনে হয় প্রথম পর্যায়ের সংস্করণ থেকে হয়তবা এ উদ্ধৃতি নেয়া হয়েছে।
৫. আধুনিক যুগ-জিজ্ঞাসার জবাব ও মানব রচিত মতবাদের সমালোচনা: সাইয়েদ কুতুব এ তাফসীরে কুরআন শরীফের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন এবং মানুষের প্রতি দিনের কর্মে ও বিশ্বাসে এর গুরুত্ব কতটুকু তা নির্ণয় করেছেন। তিনি আধুনিক যুগ জিজ্ঞাসার জবাব এই তাফসীরের মাধ্যমে দিয়েছেন।
এ তাফসীর একটি বিস্তারিত তাফসীর। এটি সংক্ষিপ্ত তাফসীর নয়। এ বিস্তারিত প্রয়োজন ছিল। এ তাফসীরে তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার তীব্র সমালোচনা করেছেন, তাদের চিন্তাধারা, দর্শন ও নৈতিকতার অসম্পূর্ণতা ও অসারতা তুলে ধরেছেন। আধুনিক যুগের বিভিন্ন মতবাদ তথা পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদসহ মানব রচিত মতবাদ যে অসার তিনি কুরআনের তাফসীর করতে গিয়ে তা প্রমাণ করেছেন। যেমন কার্লমার্ক্স ধর্মকে আফীম বলে আখ্যায়িত করেছিল। সাইয়েদ কুতুব সূরা আল-মুতাফফিফীনের ব্যাখ্যার এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, মানব জীবনের উপর ইসলামী আদর্শের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য প্রতিরোধ করতে যারা যুগে যুগে ও দেশে দেশে তৎপর, তারা এ সত্যটাকে খুব ভাল করে উপলব্ধি করে থাকে। তারা খুব ভাল করেই জানে যে, তাদের কৃত্রিম জীবন রীতি, গায়ের জোরে ছিনতাই করা সুযোগ-সুবিধা, ঘুণে খাওয়া সমাজ ও রাষ্ট্র এবং বিকৃত চরিত্র ও চালচলন,এর কোনটাই ইসলামের চির অটুট ও সুমহান আদর্শের সামনে টিকে থাকতে সক্ষম নয়। যুলুমবাজ, স্বৈরাচারী, খোদাদ্রোহী ও ধোঁকাবাজ লেকেরা তাই তাদের ধোঁকাবাজী ও শোষণ যে পর্যায়েরই হোকনা কেন, শুধু আর্র্থিক শোষণে সীমাবদ্ধ থাকুক অথবা সকল অধিকার ও কর্তব্যের ক্ষেত্রে বিস্তৃত হোক, ইসলামের শাশ্বত ও পরিচ্ছন্নœ নীতির আধিপত্য ও কর্তৃত্ব মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিস্তার করাকে তারা সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। কারণ এ আদর্শ মোটেই আপোস, দরকষাকষি অথবা স্বার্থের ভাগাভাগিকে প্রশ্রয় দেয়না৭৫।
তিনি সূরা আল-আস্রের এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন যে, ডারউইনবাদ, ফ্রয়েডবাদ ও মাক্সবাদ মানব জাতির উপর আপতিত জঘন্যতম আপদ। এ সব মতবাদ মানুষকে এই ধারণা দেয় যে,প্রত্যেক নীচতা, হীনতা, নোংরামী ও দুষ্কৃতি অত্যন্ত স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত জিনিস। এতে অস্বাভাবিক ও নতুনত্ব কিছু নেই, লজ্জারও কিছু নেই। অথচ আসলে তা মানবতার বিরুদ্ধে একটা নিন্দনীয় নিকৃষ্ট অপরাধ৭৬। এভাবে সাইয়েদ কুতুবের তাফসীরের বিভিন্ন স্থানে মানব রচিত মতবাদের সমালোচনা বিদ্যমান।
৬. আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশ্লেষণে মধ্যমপন্থা অবলম্বন: আধুনিক আবিষ্কার উদ্ভাবন এমন বহু বিষয়কে আমাদের সামনে হাযীর করছে, যার ফলে দিন দিন আল্লাহ্ তা‘আলার বাণীগুলোই সত্যে পরিণত হচ্ছে। সাইয়েদ কুতুব আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের তত্ত্ব ও তথ্য দ্বারা উপকৃত হয়েছেন, তাঁর তাফসীরের কোথাও কোথাও এধরনের বিশে¬ষণও করেছেন, যেমন, সূরা আল-‘আলার তাফসীরে নিউইয়র্কস্থ বিজ্ঞান একাডেমীর চেয়ারম্যান বিজ্ঞানী ক্রেসী মোরিসন রচিত ‘মানুষ একাকী বাস করেনা’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে চমৎকার বৈজ্ঞানিক বিশে¬ষণ করেছেন৭৭। এভাবে সূরা আন্ নাযিয়াত, আবাসা, আত্ তারিকসহ কুরআনের বিভিন্ন স্থানে চমৎকার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ তাঁর তাফসীরে দেখা যায়। তবে তিনি মনে করতেন, কুরআন এমন কোন গ্রন্থ নয় যে, এটাকে বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। তিনি সে সকল লেখকদের সমালোচনা করেছেন, যারা কুরআন থেকে বিজ্ঞান প্রমাণের জন্য ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। যেমন, তিনি সূরা বাকারার ১৮৯ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেছেন, এ আয়াতে আল্লাহ্ তায়ালা মুসলমানদের
বাস্তব জীবনে ও কর্মক্ষেত্রে চাঁদের স্বার্থকতা ও ভূমিকা কি, সে বিষয়ে অবহিত করেছেন। মহাশূণ্যে চাঁদের আবর্তন-বিবর্তন কিভাবে হয়, সে ব্যাপারে তথ্য দেননি, যদিও প্রশ্নের ভিতরে সেটাই জানতে চাওয়া হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল যে, চাঁদ এমন সরু হয়ে যায় কেন, ইত্যাদি ইত্যাদি? সৌরমন্ডল বা মহাশূণ্যে পরিভ্রমণরত জ্যেতিষ্ক মন্ডলীর ভারসাম্য রক্ষায় চাঁদের ভূমিকা কি, সে সম্পর্কেও আল্লাহ্ কোন কথা বলেননি। একথা অবিসম্বাদিত যে, কুরআন এসেছিল একটি বিশেষ আদর্শ ও চিন্তাধারার উন্মেষ ঘটাতে, একটি বিশেষ জীবন যাপন পদ্ধতি ও বিশেষ সমাজ গড়ে তুলতে। এ প্রশ্নের যদি বৈজ্ঞানিক জবাব দেয়া হতো,হয়তোবা তাদের প্রশ্নকারীদের মহাশূন্য সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান সরবরাহ করতো। যেহেতু তৎকালে এ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান ছিল খুবই কম,তাই এই রূপ বৈজ্ঞানিক জবাব পেলে তাদের এই জ্ঞান পূর্ণতা লাভ করতো। কিন্তু কুরআন এই বৈজ্ঞানিক জবাব এড়িয়ে যাওয়ার কর্মপন্থা অবলম্বন করেছে। কেননা তখনো মানব জাতি ঐ ধরনের জবাব উপলব্ধি করার মতো যোগ্য হয়ে উঠেনি। আর কুরআনের সেই প্রাথমিক উদ্দেশ্য সফল করতেও তা তেমন সহায়ক হতোনা, যার জন্য কুরআন নাযিল হয়েছিল। তা ছাড়া কুরআন এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আলোচনার উপযুক্ত ক্ষেত্রও নয়। কেননা কুরআন এসেছিল এই সব খুঁটিনাটি তথ্যের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে। এটা নিছক মহাশূণ্যে বিজ্ঞান, রসায়ন কিংবা চিকিৎসা বিদ্যার পুস্তুক হিসাবে নাযিল হয়নি। অথচ কুরআনের অতি উৎসাহী ভক্তদের কেউ কেউ কোথায় কোন বিজ্ঞান বিরুধি তত্ত্ব পাওয়া যায় তার অন্বেষণে গলদঘর্ম হয়ে থাকে৭৮।
সাইয়েদ কুতুবের মতে, উক্ত উভয় ধরনের প্রচেষ্টার মূলে রয়েছে এই মহাগ্রন্থের স্বভাব প্রকৃতি,তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং তার কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝি। কুরআনের কর্মক্ষেত্র হচ্ছে মানুষের সত্তা ও জীবন। তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো সৃষ্টি জগত সম্পর্কে, স্রষ্টার সাথে গোটা সৃষ্টি জগতের সম্পর্কের ধরন ও প্রকৃতি সম্পর্কে এবং সৃষ্টি জগতে মানুষের অবস্থান ও তার প্রতিপালকের সাথে তার সংযোগ ও সম্মন্ধ সম্পর্কে সঠিক ও পূর্ণাংগ ধারণা প্রদান। আর এই ধারণার ভিত্তিতে এমন একটা জীবন যাপন পদ্ধতি প্রবর্তন ও প্রতিষ্ঠা করাও তার উদ্দেশ্য, যা মানুষকে তার যাবতীয় শক্তি নিয়োজিত করার সুযোগ করে দেবে। বলা বাহুল্য, মানুষের এই শক্তির মধ্যে তার বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিও অন্তর্ভুক্ত। এই বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি মানুষের অন্য সকল শক্তিকে সঠিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ও সুগঠিত করার পর এবং তার কর্মক্ষেত্র উন্মুক্ত করার পর তার সাধ্য অনুসারে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা পরিচালনা ও তার ফলাফল অর্জন করে থাকে। অবশ্যই সেই ফলাফল স্বভাবতই চূড়ান্ত নয় এবং সর্বাত্মকও নয়৭৯।
সাইয়েদ কুতুবের উপরোক্ত উদ্ধৃতি থেকে স্পষ্ট যে,তিনি তাঁর তাফসীরে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব উল্লেখ করেছেন, তবে কারো কারো মতো তিনি কুরআন দিয়ে বিজ্ঞান প্রমাণ বা বিজ্ঞান দিয়ে কুরআন প্রমাণের চেষ্টা করেননি। তিনি মনে করেন,বিজ্ঞান আমাদেরকে একটা আপেক্ষিক তথ্য দান করে,যা চূড়ান্ত ও সর্বশেষ সত্য নয়; বরং বাতিল বা পরিবর্তনযোগ্য। কিন্তু কুরআনের আয়াত আমাদেরকে একটি অকাট্য ও শাশ্বত সত্য জানায়। সেই অকাট্য ও শাশ্বত সত্য এই যে,সূর্য স্থির নয় গতিশীল। বিজ্ঞান এক্ষেত্রে একেক সময় একেক ধরনের মত ব্যক্ত করেছে। কারণ বিজ্ঞান যে সিদ্ধান্ত ব্যাক্ত করে তা মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও সাজ সরঞ্জামের উপর নির্ভরশীল। আর মানুষের এই জিনিসগুলো সব সময় একই ধরনের বা চূড়ান্ত ও সর্বাত্মক সিদ্ধান্ত দেবে তা স্বভাবতই সম্ভব নয়। সাইয়েদ কুতুব বিজ্ঞানকে চূড়ান্ত মনে না করলেও বিজ্ঞান থেকে উপকৃত হতে নিষেধ করেননি। তিনি বলেন,তবে এ সব কথার অর্থ এ নয় যে,আমরা বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত তত্ত্ব ও তথ্য দ্বারা আদৌ উপকৃতই হবনা। জীবন জগত ও মানুষ সংক্রান্ত যে সব নব নব তত্ত্ব ও তথ্য বিজ্ঞান আবিষ্কার করে চলেছে, তাকে অন্তত কুরআন বোঝার কাজে ব্যবহার না করে আমরা কিছুতেই থাকতে পারিনা। আমাদের বক্তব্যের অর্থ এটা ছিলনা যে, আমরা বিজ্ঞানকে একেবারে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবো। তিনি মনে করেন, বিজ্ঞান প্রকৃতির মুক্ত প্রান্তরে ও মানবীয় সত্তার অভ্যন্তরে লুকানো আল্লাহ্র যে সব নিদর্শনকে প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করছে, তা নিয়ে সব সময় চিন্তা-ভাবনা ও বিচার গবেষণা চালানো আমাদের দায়িত্ব। শুধু তাই নয়, কুরআনের বক্তব্যের যে ব্যাখ্যা বিজ্ঞানের আলেকে আমরা পেয়ে থাকি, তাকে যত দূর সম্ভব প্রসারিত করাও আমাদের দায়িত্ব৮০।
৭. শাব্দিক, তাত্ত্বিক বা ফিক্হী বিশ্লেষণের পরিবর্তে আবেগময়ী উপস্থাপনা: সাইয়েদ কুতুব তাঁর তাফসীরে শাব্দিক বা তাত্ত্বিক বিশ্লে¬ষণের প্রতি গুরুত্ব দেননি। প্রাচীন বা আধুনিক কোন কোন তাফসীরে যেমনিভাবে মাসলা-মাসায়েল বা শাব্দিক বিশে¬ষণ আছে,তিনি তেমনভাবে আলোচনা করেননি৮১। অবশ্য এধরনের আলোচনার প্রয়োজন ও ছিলনা। কেননা তা অন্যান্য তাফসীরে বিদ্যমান। তিনি এই কুরআনের তাফসীরের মাধ্যমে পাঠক হৃদয়ে আবেগ সৃষ্টি করেছেন, যেই আবেগে পাঠক কুরআনের ছায়াতলে জীবন যাপন করতে উদ্বুদ্ধ হয়।
৮. রাসূল (সা) এর ইসলামী আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যাদান: সাইয়েদ কুতুবের তাফসীরে রাসূল (সা) এর ইসলামী আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তিনি নিজে ইসলামী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন আর ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পথনির্দেশনা দান করেছেন, এ তাফসীরের মাধ্যমে।
৯. ইসলামী জীবন বিধানের বিশ্লে¬ষণ: যেমন, সূরা আল-আস্রের তাফসীরের শুরুতে তিনি উল্লেখ করেছেন, মাত্র তিনটি আয়াতের সমাহার এই ক্ষুদ্র সূরাটিতে মানব জীবনের জন্য একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান বিদ্যমান। এ জীবন বিধানের রূপরেখা,অবিকল ইসলাম যেমন মানব জীবনের জন্য হওয়া উচিৎ বলে প্রত্যাশা করে, তেমনি। সত্যি বলতে কি, এ সূরাটি তার শেষ আয়াতের সংক্ষিপ্ত কয়েকটি শব্দের মধ্য দিয়ে গোটা ইসলামী শাসনতন্ত্র ও সংবিধান রচনা ও প্রতিষ্ঠিত করেছে৮২।
১০. ইসলামী সমাজ বিপ¬বের গাইডলাইন: কুরআন নাযিল হয় ‘হুদাল লিননাস-হুদাল লিল মুত্তাক্কীন’ হিসাবে। সাইয়েদ কুতুব হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন যে, ইসলাম কোন অপূর্ণাঙ্গ, বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত দ্বীন নয়। জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগকে ইসলাম আলাদা করে দেখেনি। জীবনের কোন দিককে আংশিক ও বিচ্ছিন্নভাবে গ্রহণ করার স্বাধীনতা ইসলাম দেয়নি। ইসলামই একমাত্র পরিপূর্ণ জীবন পদ্ধতি। এর মৌলিক ইবাদত, ঐতিহ্য, সামাজিক বিধি বিধান, সাংস্কৃতিক জীবন ধারা, ব্যক্তিগত অনুশাসন ও সামষ্টিক জীবনের ব্যবস্থা একটি আরেকটির পরিপূরক ও মানবতার পরিপূর্ণ বিধায়ক। ইসলামই আÍার পরিশুদ্ধি ও উৎকর্ষ সাধন, মানব সমাজের প্রকৃত সংস্কার ও সংশোধন, মানব কল্যাণ ও শান্তি বিধান, সভ্যতার উত্থান ও মানব সমাজের উন্নতি ও প্রগতির নিশ্চয়তা দান করে৮৩। ইসলাম শুধু ব্যক্তিগত জীবনে মানার জন্য নয়, বরং সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য এসেছে। তিনি তাঁর তাফসীরে ইসলামী সমাজ বিপ্ল¬বের পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন তুলে ধরেছেন।
১১. দাওয়াত ইলাল্ল¬াহ্র উত্তম তাফসীর : কুরআন মাজীদ আল্লাহ্র পথে দাওয়াত দানের সর্বোত্তম গ্রন্থ। তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন সেই দাওয়াতী কিতাবের সর্বোত্তম দাওয়াতী তাফসীর। সাইয়েদ কুতুব তাঁর তাফসীরে দাওয়াত ইলাল্ল¬াহর পদ্ধতি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনের দাওয়াত ইলাল¬াহর টেকনিকের উপর পি-এইচ-ডি গবেষণাও হয়েছে। বইটির নাম ‘তারীক আদ্দাওয়া ফী যিলালিল কুরআন’৮৪।
১২. ইসলামী তারবিয়াতের উত্তম তাফসীর: সাইয়েদ কুতুব মনে করতেন যে, ইসলামী সমাজ বিপ্ল¬বের জন্য নৈতিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একদল লোক প্রয়োজন। তিনি মনে করেন,আল-কুরআন মানুষের চিন্তার পরিশুদ্ধি ও তারবিয়াতের জন্য নাযিল হয়। এই কিতাবের বাহক ছিলেন, রাসূলে কারীম (সা), তিনি এই কুরআনের আলোকে এমন সঙ্গী-সাথী জগৎবাসীকে উপহার দেন,যার নজীর মানব ইতিহাসে নেই। সাইয়েদ কুতুব সূরা আল-আসরের তাফসীরের এক জায়গায় উল্লেখ করেন, নৈতিক প্রশিক্ষণ ও আত্মশুদ্ধির ব্যবস্থা না করে তারা নেতৃত্ব ও শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেনি, যেমনটি অধিকাংশ জাতি, ব্যক্তি ও শাসকরা অতীতে ও বর্তমানে করেছে ও করে থাকে। তারা দীর্ঘ দিন মুহাম্মদ (সা) এর হাতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে, তাঁর সুক্ষ¥ নিখুঁত তদারকী, পরিশুদ্ধি ও পরিমার্জনের সুযোগ পেয়েছে এবং তাঁর কাছ থেকে দুনিয়ার স্বার্থ বর্জন, পরহেজগারী, আমানতদারী, অন্যকে অগ্রাধিকার দান, আল্লাহ্র ভয় এবং নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ত্বের প্রার্থী ও প্রত্যাশী না হওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করেছিল৮৫। সাইয়েদ কুতুব এই তাফসীরের মাধ্যমে ইসলামী তারবিয়াতের ও মানুষের আত্মশুদ্ধির সঠিক পথনির্দেশনা দান করেছেন৮৬।
১৩. কুরআন বোঝার সহায়ক: সাইয়েদ কুতুব প্রত্যক সূরার তাফসীরের শুরুতে সংক্ষিপ্ত সারাংশ তুলে ধরায় এবং সূরাকে অধ্যায় ও বিষয় ভিত্তিক ভাগ করায় কুরআন বুঝতে সহজ হয়৮৭।
১৪. ইসলাম ও জাহিলিয়াতের বিশ্লে¬ষণ: সাইয়েদ কুতুব এই তাফসীরে ইসলাম ও জাহিলিয়াতের পার্থক্য নির্ণয় করেছেন এবং বর্তমান বস্তুবাদী সভ্যতাকে জাহেলী সভ্যতা আখ্যায়িত করে এর তীব্র সমালোচনা করেছেন৮৮। তিনি এই তাফসীরে আধুনিক জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরার ক্ষেত্রে কলম যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন।
১৫. জ্ঞানগর্ভ তাফসীর: ফী যিলালিল কুরআন একটি জ্ঞানগর্ভ তাফসীর। এই তাফসীর গ্রন্থ অধ্যয়নের ফলে চিন্তা জগতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয়৮৮। নতুন নতুন তত্ত্ব ও তথ্যের সন্ধান মেলে।
১৬. বিভিন্ন প্র“পের দার্শনিক চিন্তাধারা ও বিরোধমুক্ত: আরবী অন্যন্য তাফসীরে যেমনি মু‘তাযিলা, আশারা, মাতুরিদিয়া, খারিজী, রাফিযী প্রভৃতি গ্র“পের দার্শনিক মতবিরোধের উল্লেখ আছে, ফী যিলালিল কুরআনে তেমনটি নেই। যার কারণে পাঠক কুরআনের সত্যিকার স্বাদ এই তাফসীরের মধ্যে পান৯০।
১৭. সঠিক ইসলামী আকীদার উপস্থাপন: সাইয়েদ কুতুব উলুহিয়াহ্, রুবুবিয়াহ্, ইবাদাহ্ প্রভৃতি শব্দের বিশ্লে¬ষণের সময় ইসলামের সঠিক আকীদা তুলে ধরেছেন৯১।
১৮. কুরআন ও সুন্নাহনির্ভর তাফসীর: সাইয়েদ কুতুব অন্যন্য গ্রন্থ থেকে তথ্য নিলেও মৌলিকভাবে কুরআন ও সুন্নাহ্র উপর ভিত্তি করেই তাফসীর করেছেন৯২।
১৯. সমসাময়িক ইস্যুর চমৎকার বিশ্লে¬ষণ: সাইয়েদ কুতুব তাঁর তাফসীরে নারী অধিকার, ইসলামী অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজনীতি সহ সমসাময়িক ইস্যুর চমৎকার বিশ্লে¬ষণ পেশ করেছেন।
২০. সাবলীল উপস্থাপনা: তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনের সাবলীল ভাষা ও উপস্থাপনা মানুষকে কুরআনে উপস্থাপিত জীবন দর্শন সম্পর্কে চিন্তা ও গবেষণাসহ সুগভীর সত্য উপলব্ধির মাধ্যমে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণময় জীবনের পথনির্দেশনা দান করে।
এ প্রসঙ্গে ঝড়ষরযরহ বলেন; ছঁঃন’ং ষধহমঁধমব ধহফ ংঃুষব ড়ভ ৎিরঃরহম রং ংরসঢ়ষব, ভৎবব ভৎড়স ঢ়যরষড়ংড়ঢ়যরপধষ লধৎমড়হ. ওঃ রং ৎিরঃঃবহ রিঃযরহ ঃযব ফড়সধরহ ড়ভ ঃযব ছঁৎধহ, যিরপয ংঃরসঁষধঃবং ঃযব ৎবধফবৎ ঃড় ংববশ ফববঢ়বৎ ধপপবংং. ওঃ রহফরপধঃবং ঃযধঃ ঃযব ৎিরঃবৎ যরসংবষভ রং ফববঢ়ষু রহভষঁবহপবফ নু ঃযব ংরসঢ়ষরপরঃু ড়ভ ঃযব ছঁৎধহ, যিরপয পধহ ধধিশবহ ঃযব ংঢ়রৎরঃ ড়ভ ঃযড়ংব যিড় ৎবধফরষু ধপপবঢ়ঃ মঁরফধহপব.৯৩
তাফসীরের মূলনীতি ও তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন: তাফসীর সংক্রান্ত উল্লিখিত আলোচনার আলোকে এখন মূল্যায়ন করা প্রয়োজন, তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনে এই সব মূলনীতি কতটুকু অনুসৃত হয়েছে?
তাফসীরের প্রধান উৎস হচ্ছে আল-কুরআন। সাইয়েদ কুতুব তাঁর তাফসীরে আল-কুরআনকেই প্রধান উৎস হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তিনি তাফসীরের বিভিন্ন স্থানে এক আয়াতের ব্যাখ্যায় অপর আয়াত উল্লেখ করার অনেক নজীর বিদ্যমান। তিনি কুরআন দ্বারা কুরআন বুঝেছিলেন এবং কুরআন দ্বারা কুরআনের ব্যাখ্যা করেছেন। উপরন্তু তিনি এক জন হাফেযে কুরআন হওয়াই তাঁর পক্ষে কুরআনের ব্যাখ্যা কুরআন দিয়ে করা অনেকটা সহজ হয়েছে।
সাইয়েদ কুতুব কুরআন অধ্যয়নের ক্ষেত্রে অনুসৃত পদ্ধতি সম্পর্কে নিজেই বলেনঃ
কুরআনের বেশ কিছু তাফসীর দেখার পর আমার মনে হলো কোথায় যেন ফাঁক রয়ে গেছে। তখন আমি সরাসরি কুরআন দ্বারা কুরআনকে বুঝার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করলাম। আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, তখনই আমি সেই প্রিয় ও সৌন্দর্যমন্ডিত কুরআনের সন্ধান লাভ করলাম৯৪। সাইয়েদ কুতুব কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে যে মূলনীতি অনুসরণ করেছেন, তাঁর তাফসীরেও ঠিক একই মূলনীতি অনুসরণ করেছেন। আর এই মুলনীতির ভিত্তিতেই গ্রহণযোগ্য সকল তাফসীর লিখিত হয়েছে। তাফসীরে কুরআনের সঠিক পন্থা সম্পর্কে আল্লামা ইব্ন তাইমিয়া বলেন, কুরআনের তাফসীর স্বয়ং কুরআন দ্বারা করবে। কারণ কুরআনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোন একটি কথা কোথাও যদি সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে তবে অন্যত্র তার বিস্তারিত আলোচনা করে দেয়া হয়েছে৯৫।
আল্লামা আমীন আহসান ইসলাহী বলেন, কুরআনের তাফসীর বা ব্যাখ্যা করার চূড়ান্ত মূলনীতি হচ্ছে কুরআনের তাফসীর বা ব্যাখ্যা কুরআনের দ্বারাই করা। কুরআন মাজীদ শব্দে শব্দে নিজেই নিজের পরিচয় দিয়েছে৯৬। এই একই কথা ডঃ হোসাইন যাহাবী, ড. মান্না খালীল কাত্তানসহ সকলেই বলেছেন যে, তাফসীরের প্রধান উৎস মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। সাইয়েদ কুতুবও সেই কথা বলেছেন। এ থেকে বুঝা যায়, সর্বজনগ্রাহ্য তাফসীরকারকগণ কুরআন
ব্যাখ্যার যে মূলনীতি অনুসরণ করেছেন, সাইয়েদ কুতুবও একই মূলনীতি অনুসরণ করেছেন।
কুরআন তাফসীরের দ্বিতীয় উৎস হলো হাদীসে রাসূল (সা)। সাইয়েদ কুতুব তাঁর তাফসীরে ৯৩৩টি হাদীস উল্লেখ করেছেন, যা আল্লামা আলভী সাকাফ অনেক পরিশ্রম করে সে সকল হাদীস সনদসহ পৃথক গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছেন৯৭। এ থেকে বুঝা যায়, সাইয়েদ কুতুব কুরআন হাদীসের দলীলকে সামনে রেখেই ব্যাখ্যা করেছেন।
কুরআনের তাফসীরের অপর উৎস হলো সাহাবা ও তাবেয়ীনদের বক্তব্য। সাইয়েদ কুতুব তাঁর তাফসীরে সাহাবা ও তাবেয়ীনদের যে সকল বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন, আল্লামা আলভী সাকাফ উল্লিখিত গ্রন্থে প্রত্যেকের নাম উল্লেখ করেছেন৯৮।
তবে এটা ঠিক যে, তাঁর তাফসীরে তা‘বীল তথা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যায় যে মতটি তিনি অধিক গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন, সে মতটিই উল্লেখ করেছেন। আর বিভিন্ন বিষয়ে ইজতিহাদলব্ধ অভিমত পেশ করেছেন। ইসলামী চিন্তাবিদদের ইজতিহাদলব্ধ অভিমতের ক্ষেত্রে একেক জনের একেক মত থাকতে পারে। কুরআন সুন্নাহর মূলনীতির আলোকে ইজতিহাদ হলে সে ইজতিহাদ দোষনীয় নয়। তাই সাইয়েদ কুতুবের তাফসীরে তাঁর যে সব অভিমত বিদ্যমান, তার কারণে এটাকে তাফসীরের পরিবর্তে সাইয়েদ কুতুবের কল্পনার প্রকাশ বলে অভিমত পেশ করার সুযোগ নেই। সাইয়েদ কুতুব তাঁর তাফসীরে কুরআনকে একটি জীবন ব্যবস্থা হিসাবে তুলে ধরেছেন। আধুনিক যুগের যাবতীয় জিজ্ঞাসার জবাব এ তাফসীরে তিনি দিয়েছেন। এটা ঠিক একেক তাফসীরকার এক একটি বিষয় তাফসীরে বিশেষভাবে তুলে ধরেন। কারো তাফসীর কুরআন-সুন্নাহ্ নির্ভর৯৯ আর কারো তাফসীরে কুরআন সুন্নাহ্র আলোকে যুক্তি বেশি১০০। কেউ ব্যাকরণ১০, কেউ দর্শন১০২, কেউ সাহিত্যিক মান১০৩, কেউ আইন-কানুন১০৪ ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব দেন। একেক তাফসীরের একেক বৈশিষ্ট্য। তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনে সাইয়েদ কুতুব যে আবেগ সৃষ্টি করেছেন, তা এ তাফসীরের বৈশিষ্ট্য। এ সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
এখন আলোচনা করা দরকার, একজন মুফাসসিরের জন্য যে সব জ্ঞান থাকা আবশ্যক, সে নীতিমালার আলোকে সাইয়েদ কুতুব কি তাফসীর করার যোগ্যতা রাখেন?
সাইয়েদ কুতুব মিসরের সর্বজন স্বীকৃত সাহিত্যিক ছিলেন। তাই আরবী ভাষা ও আরবী বাকরীতি সম্পর্কে তাঁর দক্ষতার বিষয়টি আলোচনার প্রয়োজন নেই। অপরদিকে তিনি ছোট বেলা থেকেই আল- আযহারের খ্যাতনামা পন্ডিতদের সাহচর্যে আরবী ব্যাকরণসহ আরবী ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন, তা তাঁর জীবনী সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তাঁরা সম্যক অবহিত। আর দারুল উলূম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালে তিনি হাদীস, তাফসীর, ফিক্হ, উসূল, আকাইদ, বালাগাতসহ একজন মুফাসসিরের জন্য যে সব বিষয় জানা থাকা আবশ্যক, সে সব বিষয়ে যে ব্যাপক পড়াশুনা করেছেন, তা তাঁর জীবনীতে উল্লেখ আছে। এ থেকে বুঝা যায়, সাইয়েদ কুতুবের মাঝে তাফসীর করার জন্য যে সব যোগ্যতা থাকা আবশ্যক, তা পুরাপুরি বিদ্যমান ছিল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাঁর তাফসীর কোন ধরনের তাফসীর? এ বিষয়ে আলোচনার আগে তাফসীরের ইতিহাস নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা প্রয়োজন। কেননা তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন একটি আধুনিক তাফসীর। আধুনিক তাফসীর হলেও এ তাফসীরের মাঝে প্রাচীন তাফসীরের অনুসৃত ধারা কতটুকু বিদ্যমান, সে সম্পর্কে পর্যালোচনা করা দরকার। এ জন্য প্রাচীন ও আধুনিক যুগের তাফসীরের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন। আর এ আলোচনার শুরুতেই প্রাচীন ও আধুনিক যুগের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা দরকার।
ফী যিলালিল কুরআন কোন ধরনের তাফসীর: তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা তাফসীর। আমরা যদি তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনকে পর্যালোচনা করি তাহলে নিুোক্ত কয়েকটি বিষয় দেখতে পাই ঃ
১. তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন তাফসীর বির রায় এর অন্তর্ভুক্ত একটি তাফসীর। এই তাফসীরে সাইয়েদ কুতুবের ইজতিহাদলব্ধ অনেক বিষয় বিদ্যমান। আমরা যদি এই তাফসীরকে পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাই,তিনি কুরআন-সুন্নাহ্র মৌলিক দৃষ্টিভংগীর বাইরে কোন ইজতিহাদ করেননি। অপর দিকে একজন মুজতাহিদকে যে সব বিষয়ে খেয়াল রেখে ইজতিহাদ করতে হয়, তিনি সে দিকে খেয়াল রেখেছেন। তাঁর এ তাফসীর আকলী তাফসীর হলেও তিনি নকুলী তথা হাদীসের আলোকেই তাঁর মত প্রকাশ করেছেন। তাই এই তাফসীর সর্বজন গ্রাহ্য তাফসীর১০৫।
২. তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন তাফসীর বির রায় এর অন্তর্ভুক্ত হলেও এতে অনেক হাদীস বিদ্যমান। তিনি এ তাফসীরে কোন কোন তাফসীরকারের মত কোন যয়ীফ হাদীস উল্লেখ করেননি১০৬।
৩. সাইয়েদ কুতুব এ তাফসীরে আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামআতের আকীদা তুলে ধরেছেন। কোন কোন তাফসীরে যেমনি ভ্রান্ত আকীদার প্রতিফলন দেখা যায়, এ তাফসীর সে ধরনের কলুষমুক্ত। বরং এ তাফসীরে আকীদার বিশুদ্ধতার জন্য সাইয়েদ কুতুব কলম যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন১০৭।
৪. সাইয়েদ কুতুব তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনের উৎস হিসাবে কুরআন, হাদীস, সাহাবা ও তাবেয়ীনদের বক্তব্যকেই গ্রহণ করেছেন, তিনি পাশ্চাত্যের লেখকদের বিভ্রান্তিকর লেখার জবাব কোথাও কোথাও দিলেও তাঁর এ তাফসীরে পাশ্চাত্যের লেখকদের উদ্ধৃতি নেহায়েতই কম১০৮।
৫. সাইয়েদ কুতুব এ তাফসীরে ফিক্হী বা শাব্দিক বিশ্লেষণের পরিবর্তে ভাবাবেগ সৃষ্টির প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই এ তাফসীরে কোন বিষয়ের জটিল বিশ্লেষণ নেই। যে কোন পাঠক এ তাফসীর অধ্যয়নের সময় তার মনে আবেগ সৃষ্টি না হয়ে পারেনা। তিনি কুরআনের ছায়াতলে বসবাস করে যে স্বাদ পেয়েছেন সে স্বাদ আস্বাদনের জন্য পাঠকদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এ দৃষ্টিতে এ তাফসীর এক আবেগ সৃষ্টিকারী তাফসীর। বান্দার সাথে আল্লাহ্র গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি করাই ছিল এর টার্গেট১০৯।
৬. সাইয়েদ কুতুব এ তাফসীরে আধুনিক যুগ-জিজ্ঞাসার অনেক জবাব দিয়েছেন। ইমাম আব্দুহু থেকে আধুনিক তাফসীরের যে ধারা চালু হয়েছে,সে দৃষ্টিতে এ তাফসীর একটি আধুনিক তাফসীর। কিন্তু আধুনিক কোন কোন তাফসীরের মত এ তাফসীরে জ্ঞান বিজ্ঞানের ব্যাপক আলোচনা নেই। কেননা সাইয়েদ কুতুব মনে করেন, কুরআন কোন বিজ্ঞান গ্রন্থ নয়। তাঁর দৃষ্টিতে কুরআনকে বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করা জরুরী নয়। আবার তিনি প্রয়োজনে বিজ্ঞানের তত্ত্ব ও তথ্য থেকে উপকৃত হয়েছেন। তাই বলা যায়, এটি আধুনিক তাফসীর হলেও সাইয়েদ কুতুব এ তাফসীরে কুরআন নাযিলের আসল টার্গেটের প্রতি খেয়াল রেখেছেন বেশি১১০।
৭. কোন কোন তাফসীরে যে ভাবে ইসরাঈলী বর্ণনা দেখা যায়, তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনে এ ধরনের কোন ইসরাঈলী বর্ণনা নেই। সাইয়েদ কুতুব ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত ছিলেন, যা অনেক তাফসীরকারকের পক্ষে সম্ভব হয়নি১১১।
৮. সাইয়েদ কুতুব একজন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক ছিলেন, তাই তাঁর এই তাফসীরের সাহিত্য মান খুবই উচ্চাংগের। কেউ কেউ তাঁর ব্যবহৃত শব্দের সঠিক তাৎপর্য উপলব্ধি করতে না পেরে সমালোচনা করেছেন। প্রকৃত পক্ষে সমালোচকদের সমালোচনা যথার্থ নয়। তবে এটা ঠিক মানুষ হিসাবে কেউ ভুলের উর্ধ্বে নয়। আর ইজতিহাদী বিষয়ে একেক জনের একেক মত থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়১১২।
৯. সাইয়েদ কুতুব ইসলামী আন্দোলনের সাথে স¤পৃক্ত ছিলেন। তিনি ইসলামী আদর্শের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য জেল খেটেছেন। কারাগারেই তিনি এ তাফসীরের অধিকাংশ অংশ লেখেন। তাঁর এ তাফসীরে ইসলামী আন্দোলনের বিস্তারিত গাইডলাইন বিদ্যমান। এ দৃষ্টিতে তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন গতানুগতিক ধারার কোন তাফসীর নয়, এতে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার বিস্তারিত বিশ্লেষণ বিদ্যমান১১৩।
১০. সাইয়েদ কুতুব নিজস্ব ধারায় তাফসীর লিখলেও এই তাফসীরে প্রাচীন ও আধুনিক অন্যান্য তাফসীরের উদ্ধৃতির মাধ্যমে তাফসীরের ধারা অনুসরণ করা হয়েছে। যেমন তিনি এই তাফসীরে ইব্ন জারীর তাবারী, ইব্ন কাসীর, কাশশাফ, বায়দাবী, জাসসাস, কুরতুবী ও ইবনুল আরাবী রচিত আহকামুল কুরআন, আলূসী রচিত রূহুল মায়ানী, সুয়ূতী রচিত জালালাইন ও আদ দুর আল-মানসূর, আল্লামা রশীদ রিযা, ইমাম আব্দুহু ও সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ) সহ প্রাচীন ও আধুনিক অন্যান্য তাফসীর থেকে অনেক উদ্ধৃতি দিয়েছেন১১৪। তাই এ তাফসীরকে সাইয়েদ কুতুবের মনগড়া তাফসীর বলার সুযোগ নেই। আর যারা মনে করেন, সাইয়েদ কুতুব এই তাফসীর জেলখানায় লেখেছেন, সেখানে প্রয়োজনীয় তথ্য ছিলনা,তাই তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনে তাফসীরের পরিবর্তে সাইয়েদ কুতুবের মনের আবেগই প্রকাশিত হয়েছে। তাদের এ ধারণা ঠিক নয়। তবে এ কথা ঠিক যে,ফী যিলালিল কুরআনে আবেগময়ী উপস্থাপনা বিদ্যমান। তবে এ আবেগ নিছক কল্পনার প্রকাশ ছিলনা, এই আবেগময় উপস্থাপনার পিছনে ছিল কুরআন-হাদীস ও অন্যান্য তাফসীরকারকদের উদ্ধৃতি।
সাইয়েদ কুতুব অন্যান্য তাফসীরের উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর বক্তব্য প্রমাণের চেষ্টা করেছেন সত্য, কিন্তু অন্যান্য তাফসীরের চেয়ে তাঁর তাফসীরে কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। অবশ্য প্রত্যেক ফুলের যেমনি পৃথক সুবাস থাকে, তেমনি প্রত্যেক তাফসীরের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে।
সাইয়েদ কুতুব অন্যান্য তাফসীর অধ্যয়ন করেছেন, উপকৃত হয়েছেন। কিন্তু সে তাফসীরের ধারা হুবহু অনুসরণ করেননি। যেমন- ইব্ন জারীর তাবারী সনদসহ সকল হাদীস উল্লেখ করেছেন, কোন বিষয়ে যত মত ছিল সবই উল্লেখ করেছেন, কোন মতকেই অগ্রাধিকার দেননি। পক্ষান্তরে সাইয়েদ কুতুব যে মতটি গ্রহণযোগ্য তা উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর অনুসৃত নীতি ইব্ন কাসীরের অনুসৃত নীতির কাছাকাছি।
তিনি জাসসাস, ইব্ন আরাবী, কুরতুবী ও আবূ সাউদ রচিত তাফসীর থেকে উপকৃত হয়েছেন, তবে তাঁদের মত কোন নির্দিষ্ট মায্হাব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেননি। তাঁর তাফসীরে ফিক্হী মাসায়েল যতটুকু আলোচিত হয়েছে, এতে গ্রহণযোগ্য মতের উল্লেখ দেখা যায়। আর কখনও কখনও সকল মতই উল্লেখ করেছেন১১৫।
সাইয়েদ কুতুব তাফসীরে কাশশাফ থেকে উপকৃত হয়েছেন, তবে শাব্দিক বিশ্লেষণ তাঁর মত করেননি। আবার তাঁর তাফসীরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআতের আকীদার প্রতিফলন ছিল, যা আল্লামা যামাখশারীর মু‘তাযিলা আকীদাকে সমর্থন করেনা। তবে তিনি কোন কোন তাফসীরকারকের মত মুতাযিলা বা বিশেষ কোন ফেরকার আকীদার জবাব দানের জন্যই শুধু তাফসীর লেখেননি। তাঁর তাফসীরে ইসলামের সার্বজনীন জীবন দর্শনের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা বিদ্যমান।
সামগ্রিক পর্যালোচনায় এ কথা বলা যায়, তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা তাফসীর। এটি সর্বজনগ্রাহ্য তাফসীর। ফী যিলালিল কুরআন তাফসীর বির রায় হলেও কুরআন-হাদীসের আলোকেই তিনি ইজতিহাদ করেছেন। এটি আধুনিক যুগে লিখিত হলেও প্রাচীন তাফসীরের অনেক বৈশিষ্ট্য এতে বিদ্যমান।
সাইয়েদ কুতুব এ তাফসীরের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর এক বিরাট খিদমাত আঞ্জাম দিয়েছেন। তাই মুসলিম বিশ্বের সর্বত্রই এই তাফসীর বহুল পঠিত ও ব্যাপক আলোচিত।

উদাহরণ স্বরূপ তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন থেকে সূরা বাকার ২৮৫-২৮৬নং আয়াতের তাফসীর উল্লেখ করছি।

অর্থঃ “আল্লাহ্র রাসূল সেই বিষয়ের ওপরই ঈমান এনেছে, যা তার ওপর তার মালিকের পক্ষ নাযিল করা হয়েছে- আর যারা ঈমান এনেছে। এদের সবাই (একই বিষয়ের ওপর ঈমান এনেছে) ঈমান এনেছে, আল্লাহ্র ওপর, কার ফেরেস্তাদের ওপর, তার (পাঠানো) কেতাবের ওপর তার (মনোনীত) রাসূলদের ওপর, (তারা আরো বলে যে,) আমরা আল্লাহ্র পাঠানো নবী রাসূলদের মাঝে কোন রকম পার্থক্য করি না, আমরা তো (আল্লাহ্র নির্দেশ) শুনেছি এবং (নিজেদের জীবনে তা) মেনেও নিয়েছি। হে আমাদের মালিক, আমরা তোমার ক্ষমা চাই। (আমরা জানি) আমাদের একদিন তোমার কাছেই ফিরে যেতে হবে।. আল্লাহ্ তা‘আলা কখনো (তার সৃষ্টি করা) কোনো প্রাণীর ওপরই তার শক্তি সামর্থের বাইরে কোনো কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না, সে ব্যক্তির জন্যে ততোটুকুই (পুরস্কার) রয়েছে যতোটুকু (কাজ) সে (এ দুনিয়াতে) সম্পন্ন করেছে, আবার পাপের শাস্তিও তার ওপর ততটুকু পড়বে যতোটুকু পরিমাণ অন্যায় সে (এই দুনিয়ায়) করে এসেছে, হে মু’মিন ব্যক্তিরা এই বলে তোমরা দোয়া কর ‘হে আমাদের মালিক! যদি আমরা কিছু ভুলে যাই, জীবনে চলার পথে কোথাও যদি আমরা কোনো ভুল করে বসি, তার জন্যে তুমি আমাদের পাকড়াও করো না, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ওপর যে ধরনের বোঝা তুমি চাপিয়েছিলে, তা আমাদের ওপরও চাপিয়ো না, হে আমাদের মালিক- যে বোঝা বইবার শক্তি সামর্থ আমাদের নেই, তা তুমি আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ো না, তুমি আমাদের ওপর মেহেরবানী করো, আমাদের তুমি মাফ করে দাও, আমাদের ওপর তুমি দয়া করো, তুমিই আমাদের (একমাত্র) আশ্রয় দাতা বন্ধু, অবিশ্বাসী কাফেরতেদর মোকাবেলায় তুমি আমাদের সাহায্য করো। ” (সূরা বাকারা ঃ ২৮৫-২৮৬)
তাফসীর ঃ এই আয়াতগুলো হচ্ছে কুরআনের দীর্ঘতম সূরাটির পরিশিষ্ট। এই সূরা একদিকে যেমনি দীর্ঘ তেমনি বিষয়বস্তুর আলোকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই সূরায় ঈমানী ধ্যান ধারণায় মৌলিক নীতিমালার আলোচনা করা হয়েছে, এতে আরো আলোচিত হয়েছে ইসলামী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য, তার কর্মনীতি, তার ওপর অর্পিত দায়িত্বসমূহ, সর্বোপরি এই ধরনের একটি আসলামী দলের অস্তিত্বের মূল উদ্দেশ্যও এখানে স্ববিস্তারে আলোচিত হয়েছে, আরো বলা হয়েছে ইসলামী সংগঠনের দুশমন কারা কারা, মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ বিগ্রহের সময় এরা কোন কোন পন্থা অবলম্বন করে থাকে, একই ভাবে এই সূরায় মানুষের সৃষ্টি ও তার উদ্দেশ্যের বিষয়টির বর্ণনা এসেছে। তার প্রকৃতি ও ভুল ভ্রান্তির ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর আলোকে তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য তুলে ধরা হয়েছে।
এই শেষের আয়াত দু’টি হচ্ছে গোটা সূরার পরিশিষ্ট ও এর সংক্ষিপ্ত সার। এই সূরায় আলোচিত অধিকাংশ বিষয়েরই এই দু’টি আয়াতে সারসংক্ষেপ বর্ণনা করা হয়েছে, আর এভাবেই গোটা সূরায় বিষয়াবলী ও এর লক্ষ্য সমূহের সাথেঃ এই পরিশিষ্টের একটা সুন্দর সামঞ্জস্য সাধিত হয়ে গেছে। যেমনি করে এই সূরাটি শুরু হয়েছিলো এই আয়াতের মাধ্যমে আলিফ লাম মীম, এই মহাগ্রন্থ (আল কুরআন) যাতে কোন রকম শোবা সন্দেহ নাই। এই কেতাব শুধু তাদের জন্যেই পথ প্রদর্শক যারা (আল্লাহকে) ভয় করে এরা (আল্লাহ্কে ভয় করা লোকগুলো) হচ্ছে যারা না দেখে তার ওপর ঈমান আনে। এবং (সে ঈমানের দাবী মোতাবেক) নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং আমার দেয়া সম্পদ থেকে (আমারই) পথে ব্যয় করে, যারা (হে মুহাম্মদ) তোমার ওপর নাযিল করা কিতাবের ওপর ঈমান আনে- ঈমান আনে তোমার পূর্ববর্তী রাসূলদের ওপর অবতির্ণ কিতাব সমূহের ওপর সর্বোপরি যারা ঈমান আনে শেষ বিচারের দিনের ওপর। সে আয়াতগুলোতে যে মৌলিক সত্যগুলো- বিশেষ করে সব কয়জন নবী রাসূলের ওপর ঈমান আনার বিষয়টি আলোচিত হযেছে, তারই সূত্র ধরে সূরাটির পরিসমাপ্তি টানা লো এই বলে- হাঁ আল্লাহ্র রাসূল তার মালিকের পক্ষ থেকে যা কিছু নাযিল করা হয়েছে তার ওপর ঈমান এনেছে। তার সাথে (তার সাক্ষী) মু’মীনরাও ঈমান এনেছে আল্লাহ্র ওপর, তার ফেরেস্তাদের ওপর তার কিতাবসমূহের ওপর ও তার রাসূলদের ওপর এবং তারা বলে, আমরা আল্লাহ্ এ নবী রাসূলদের মাঝে কোনো রকম তারতম্য করি না, (কারণ তারা সবাই আল্লাহ্র বাণী নিয়ে এসেছেন) এই ভাবেই সূরার প্রথম কথার সাথে শেষ কথার এক অপূর্ব সামঞ্জস্য সাধিত হয়ে গেছে।
সূরায়ে বাকারার বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে মুসলিম জাতির সার্বিক অবস্থার বর্ণনা, তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলা হয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ে এটা দেখানো হয়েছে যে, বণী ইসরাঈলের লোকেরা কিভাবে এই দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন থেকে দূরে থাকতে চেয়েছে এবং কিভাবে এ দায়িত্ব, পালনে অবহেলা করেছে আসলে আল্লাহ্ তা‘আলা কোনো ব্যক্তি কিংবা জাতি কারো ওপরই তার ক্ষমতা ও সামর্থের বাইরে কোনো দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেন না- ইহুদীদের ধারণা অনুযায়ী আল্লাহ্ তা‘আলা আবার কখনো ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীকে কোনো কাজ কর্মের দায় দায়িত্ব না দিয়ে নিঃষ্কর্মা ও অথর্ব করেও রাখেন না, বলা হয়েছে, আল্লাহ্ তা‘আলা কাউকেই তার নিজস্ব শক্তি সামর্থের বাইরে কেষ্ট দেন না। (তার নীতি হচ্ছে) ততোটুকুই বান্দার পাওনা হবে যতোটুকু সে অর্জন করবে- ভালো কাজ করলে সে তার বিনিময় পাবে আবার মন্দ কাজ করলে তার ক্ষতির বোঝা তার ওপরই বর্তাবে।
এই সূরায় বণী ইসরাইলের কিছু কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে, তাদের ওপর আল্লাহ্ তা‘আলার অনুগ্রহ ও নেয়ামতের বিস্তারিত বিবরণ পেশ করা হয়েছে, এও বলা হয়েছে এতো বিপুল পরিমাণ নেয়ামত ও অনুগ্রহ সত্বেও তারা কিভাবে আল্লাহ্র সাথে বিদ্রোহ করেছে, পরিণামে তাদের ওপর এমন কিছু কাফফারা আরোপ করা হয়েছে যা হত্যার মতো কঠোর বিধানের কাছে পৌঁছে গেছে, যেমন বলা হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের মালিকের দযারে তৌবা করো তোমাদের নিজেদের প্রকৃতিকে হত্যা করে ফেলো’ এর শেষ পর্যায়ে মু’মীনদের হৃদয় থেকে এই আকুতিপূর্ণ দোয়া আসছে হে আমাদের মালিক, ‘আমরা যদি কোনো ভুল করি আমাদের থেকে যদি কোনো ত্র“টি বিচ্যুতি হয়ে যায় তাহলে তুমি আমাদের তার জন্যে পাকড়াও করোনা আমাদের উপর তুমি এমন কোনো বোঝা দিয়ো না যা তুমি আমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর দিয়েছো। হে আমাদের মালিক, যে পরিমাণ বোঝা বইবার শক্তি সামর্থ আমাদের তার অধিক বোঝা তুমি আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়োনা, হে আমাদের মালিক আমাদের গুনাহ খাতা মাফ করে দিয়ো আমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দিয়ো, আমাদের ওপর তুমি দয়া করো।
এই সূরায় মুসলমানদের ওপর যুদ্ধ ফরজ করা হয়েছে তাদের জেহাদের আদেশ দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহ্র পথে অকাতরে ব্যয় করতে বলা হয়েছে।
তাদের বলা হয়েছে ‘কুফর’ ও ‘কাফেরদের’ নিরর্মূল করার জন্যে জেহাদের পথে এগিয়ে আসতে- এবার শেষের দিকে এসে মু’মীনের পক্ষ থেকে এই তাদের মালিকের সাহায্য চেয়ে শত্র“দের মোকাবলোয় বিজয় ও সাহায্য কামনা করে এই দোয়ার আবেদন পেশ করা হচ্ছেঃ ‘তুমিই আমাদের একমাত্র মালিক। কাফের ও তাদের অনুচরদের ওপর তুমি আমাদের বিজয় দাও।’
‘এই আয়াতদুটো হচ্ছে গোটা সূরায়ে বাকারর এমনি এক পরিশিষ্ট ও সংক্ষিপ্ত সার যাতে মূল সূরায় আলোচিত বিষয়গুলোর একটা মোটমুটি বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এতে ঈমানের ধরন ও বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা এসেছে একজন সত্যিকারের মু’মীনের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে, প্রতিটি কথার মূলে রয়েছে একই আহ্বান, পরিশেষে মু’মনি কিভাবে বিনয়ের সাথে আল্লাহ্র দরবারে দোয়াও প্রার্থনা জানাবে তাও তাকে বলে দেয়া হয়েছে।
এবার আমরা এ বিষয়ের ওপর কিছু বিস্তারিত আলোচনার প্রয়াস পাবো।
রাসূল ঈমান আনলো যা তার ওপর তার মালিকের পক্ষ থেকে নাযিল করা হয়েছে (তার সাথে তার সাথী) মু’মীনরাও ঈমান আনলো তারা সবাই ঈমান আনলো আল্লাহ্র ওপর তার ফেরেস্তাদের ওপর তার (পৌছানো) কিতাবের’ ওপর ও তার পাঠানো নবী রাসূলদের ওপর (ঈমান আনার পর তারা সবাই বললো) আমরা আল্লাহ্র পাঠানো নবী রাসূলদের মাঝে কোনো রকম তারতম্য করিনা, অতপর তারা আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে বললো, হে মালিক! আমরা তোমার কথা শুনলাম এবং তা মেনে নিলাম, হে আল্লাহ্! আমরা তোমার ক্ষমাই প্রার্থনা, করি (কেননা এই জীবনের শেষে আমাদের) একদিন তোমার কাছেই ফিরে যেতে হবে।’ এখানে মু’মীনদের সঠিক রূপ বর্ণনা করা হয়েছে। এমন একটি পছন্দ করা দল যাদের কর্মীবনে ঈমানের বাস্তব উপস্থিতি বিদ্যমান এখানে মু’মীনদের সাথে আল্লাহ্র রাসূলকে শামিল করে মূলতঃ তাদের সম্মান ও মর্যাদা বহুলাংশে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এদের উভয়কে একই বাক্যে একই আয়াতে পেশ করে তাদের সম্মানের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য আনয়ন করা হয়েছে।
যেমন বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ্র রাসূল ঈমান আনলো যা কিছু তার ওপর নাযিল করা হয়েছে তার ওপর) তার সাথে তার সাথী) মু’মীনরাও (ঈমান আনলো),
আল্লাহ্র পক্ষ থেকে যে ওহী রাসূলের নিজের ওপর নাযিল করা হয় তার ওপর তাদের নিজেদের ঈমান আনার বিষয়টি এবং আল্লাহ্র স্বীয় সত্বার সাথে সরাসরি সম্পর্কের বিষয়টি এমনি যার ধারণা নবুওয়তের সাথে জড়িত সম্মানিত ব্যক্তির ছাড়া অন্য কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। নবীদের ক্ষেত্রে এ সত্যের অনুভূতির জন্যে কোন রকম পরিশ্রম করার প্রয়োজন হয়না। চেষ্টা সাধনা ছাড়াই এ ধারণা ও অনুভূতি সদা জাগরুক থাকে এ হচ্ছে ঈমানের এমন এক পর্যায় ব্যখ্যা শুধু সে ব্যক্তিই করতে পারেন যিনি নিজে এর স্বাধ পেয়েছেন। এই হচ্ছে রাসূলের ঈমান আর আল্লাহ্ তা‘আলা এই পর্যায়ের ঈমানের ব্যাপারে নিঃসন্দেহে তাদের উপর একটা বিরাট অনুগ্রহ করেছেন। এই ঈমানের সীমা রেখা কতোটুকু?
‘তারা ঈমান আনলো আল্লাহ্ তা‘আলার ওপর তার ফেলেস্তাদের ওপর তার কেতাবের ওপর, এবং তার পাঠানো রাসূলদের ওপর। (ঈমান আনার পর তারা বলে) আমরা রাসূলদের মাঝে কোনো রকম তারতম্য করিনা। (আমরা আমাদের মালিকের দুয়ারে আরজী পেশ করে বলি) হে আল্লাহ্ আমরা তোমার কথা শুনেছি, এবং তোমার আনুগত্য কবুল করেছি, হে আমাদের মালিক আমরা তোমার ক্ষমা প্রার্থনা করি, (কারণ আমরা জানি) আমাদের (জীবনের শেষে) তোমার কাছেই ফিরে যেতে হবে।’
এই হচ্ছে সেই পূর্ণাংগ ঈমানÑ ইসলাম যার শিক্ষা দেয়, আর এ ধরনের ঈমানই মুসলমানদের থাকা উচিৎ। এই ঈমানের মাধ্যমেই কেয়ামত পর্যন্ত মানুষদের আল্লাহ্র দ্বীনের প্রতিষঠা ও তার প্রদর্শিত সঠিক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হতো। আর এই ঈমানই হামেশা দাওয়াতে দ্বীনের কর্মীদের মাঝে এবং এ দাওয়াতের বাহক নবীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যেতো। ইতিহাসের সর্বত্রই মানবতা দু’দলে বিভক্ত ছিলো একদল হচ্ছে ঈমানদার যারা আল্লাহ্র হেদায়েতের ওপর ঈমান এনে সে অনুযায়ী জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত করে, আরেক দল হচ্ছে অবিশ্বাসী কাফেরদের দল, যারা সর্বদাই ঈমানের এই সনাতন পন্থা পরিত্যাগ করে জাহেলিয়াতের পন্থা অনুসরণ করে। অপর কথায় একটি হচ্ছে আল্লাহ্র দল অপরটি হচ্ছে শয়তানের দল, মানুষের সমাজে এই দুয়ের বাইরে কখনো তৃতীয় দলের অস্তিত্ব ছিলো না।
ইসলামী জীবন পদ্ধতির মাঝে আল্লাহ্র ওপর ঈমান আনার বিষয়টি এমন একটি মৌলিক নীতি যা মু’মীনের জীবনের সব কয়টি দিক ও বিভাগে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। আল্লাহ্র ওপর ঈমান আনার অর্থ হচ্ছে সার্বভৌমত্ব, শাসন ক্ষমতা, এবাদাত ও মালিকানায় আল্লাহ্ তা‘আলা একক ও অভিন্ন এবং মানুষের জীবনের সব কয়টি দিক ও বিভাগ তারই আদেশের আওতাধীন এর কোনো ব্যাপারেই তার কোনো অংশীদার না।ি, এই বিশ্বচরাচর ও তার অধিবাসীদের জীবনের ব্যবস্থাপনায় তিনি ছাড়া আর কেনোই কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই তিনি ছাড়া দ্বিতীয় কিছু কারো উপকার কিংবা অপকার কিছুই করতে পারে না, তার ইচ্ছাও ইংগিত ছাড়া ছোট বড়ো কোনো কাজই এখানে সাধিত হয় না।
আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া দ্বিতীয় কারো এবাদাতের প্রশ্ন আসেনা। তিনি ছাড়া দ্বিতীয় কারো আনুগত্য কিংবা অনুবর্তন বৈধ হতে পারে না। মানুষের সব চিন্তা ও কর্মের ওপর তার একক আধিপত্য বিরাজমান তাই এই ঈমানের অপরিহার্য ও একক দাবী হচ্ছে যাবতীয় আইন কানুন তারই চলবে। নীতি নৈতিকতার নীতিমালা কি হবে, তা তিনিই বাতলে দেবেন, সামাজিক নিয়মনীতি ও অর্থনৈতিক ক্রিয়া কান্ডের সব ফর্মুলা তার কাছ থেকে গ্রহণ করতে হবে, মোট কথা জীবনের সব কয়টি দিক ও বিভাগে তারই আনুগত্য করতে হবে, জীবনকে তার বন্দেগী ছাড়া অন্য সব ধরনের বন্দেগী থেকে মুক্ত করে দিতে হবে, তার বাধন ছাড়া অন্য সব বাধন থেকেও জীবনকে মুক্তি দিতে হবে। তার শাসন ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া অন্য সব কয়টি শাসন ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি পেতে হবে। ফেরেস্তাদের ওপর ঈমানের বিষয়টি হচ্ছে ‘অদেখা জিনিষের ওপর ঈমান আনারই আরেকটি অংশ বিশেষ, এ ব্যাপারে এই তাফসীরে সূরায়ে বাকারার শুরুতে আমি আলোচনা করেছি। মূলতঃ এই ঈমান মানুষকে দৃশ্যমান দুনিয়ার বাইরে এক অদৃশ্য পৃথিবী সম্পর্কে জানার আগ্রহের সৃষ্টি করে। যদি এসব ব্যাপারে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে মানুষদের সে অ-দেখা জগত সম্পর্কে কিছু কিছু খবর বলে না দেয়া হয় তাহলে মানুষ প্রকৃতির স্বাভাবিক আগ্রহের বশবর্তি হয়ে নানা ধরনের অজ্ঞতা কুসংস্কার ও জাহেলিয়াতে নিমজ্জিত হয়ে যাবে।
ফেরেস্তাদের ওপর ঈমান আনার বিষয়টি এমন এক অদেখা বিষয়ের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা যা কোন দিনই মানবীয় প্রকৃতি ও জ্ঞান বিজ্ঞান অনুধাবন করতে পারে না। অথচ অদৃশ্য ঘটনাসমূহ জানার প্রবল আগ্রহ মানুষের প্রকৃতিতে সব সময়ই বিদ্যমান রয়েছে, একারণেই আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষদের সামনে সেই অদৃশ্য জগতের এক ঝলক দেখিয়ে তাদের বলেছেন এই ধরনের কাজে তার যোগ্যতার অপচয় না করতে। যেখানে পৌঁছার কোনো ক্ষমতাই তাকে দেয়া হয়নি। এর যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছ যে, যারা নিজেদের প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারণ করে অদৃশ্য জগতের সত্য সমূহকে অস্বীকার করে তারা গ্রকারান্তের নানা ধরনের অন্ধ বিশ্বাস ও জাহেলী ধ্যান ধারণায় নিম্িজত হযে পড়ে এবং এ ভাবেই তার জ্ঞান প্রতিভা বিনষ্ট হয়ে এদিক সেদিক পথ হারিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।
এর সাথে আরেকটি বিষয়ও রয়েছে। আল্লাহ্র ফেরেস্তাদের ওপর ঈমান আনার ফলে এই সৃষ্টি জগত সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান ও অনুভূতিতে অনেক ব্যাপকতা আসে এবং মু’মীন হৃদয়ের সেই সংকীর্ণতা দূরিভূত হয়ে যায় যার ফলে দুনিয়ার মানুষরা এই দৃশ্যমান জগতের বিষয়গুলোর প্রতি ঈমান আনার ফলে মু’মীন হৃদয়ে আল্লাহ্র অসীম জগত সম্পর্কে এক ব্যাপক অনুভূতিও সৃষ্টি হয়। তাছাড়া আল্লাহ্র একজন বিশ্বস্ত বান্দা এভাবে অদেখা জগতের আরেক সৃষ্টি হয়। তাছাড়া আল্লাহ্র একজন বিশ্বস্ত বান্দা এভাবে অদেখা জগতের আরেক সৃষ্টির সাথেও পরিচিত হতে পারে- যে আল্লাহ্ তা‘আলার ওপর ঈমান আনার ব্যাপারে তাই অংশীদার। সে সৃষ্টি শুধু যে ঈমানের ব্যাপারে অংশীদার তাই নয় সে তো প্রতিনয়ত আমাদের গুনাহমাফীর জন্যে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করে যাচ্ছে এবং সর্বত্রই আল্লাহ্র হুকুমে আমাদের ভালো কাজে সহােগিতা যুগিয়ে যাচ্ছে এই ভাবেই মু’মীনদের সাথে ফেরেস্তাদের এক সক্ষতা পরিচয় গড়ে উঠে।
‘আমরা ঈমান এনেছি তার কেতাবসমূহের প্রতি ও তার রাসূলদের প্রতি- আমরা এদের কারো সাথেই কারো কোনো ধরনের পার্থক্য করিনা।
আল্লাহ্ তা‘আলার নাযিল করা সব কয়টি কেতাবের ওপর ঈমান আনা এবং তার পক্ষ থেকে পাঠানো সব কয়জন নবী রাসূলের প্রতি কারো সাথে কারো কোন রকম পার্থক্য না করে ঈমান আনা মূলত সেই, ঈমানের অপরিহার্য দাবী, যে ঈমানের কথা ইসলাম আমাদের সামনে পেশ করেছে। কেননা আল্লাহ্ তা‘আলার ওপর ঈমান আনার দাবীই হচেছ আল্লাহ্র নাযিল করা সব কিছুরই সত্যতা স্বীকার করা, তার পাঠানো সব নবীকেই বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী স্বীকার করা এবং এভাবেই আল্লাহ্র ‘একত্ব’ কেই সব কিছুর মূল হিসেবে স্বীকার করে নেয়া যার জন্যে বিভিন্ন সময়ে আল্লাহ্র নবীরা প্রেরিত হয়েছেন এবং সব কয়টি আসমানী গ্রন্থ নাযিল করা হয়েছে। এই কারণেই একজন মুসলমানের দৃষ্টিতে সব কয়জন নবী ও তাদের সব কয়টি রেসালাতই এক ও অভিন্ন, এদের কোনোটার সাথে কোনোটারই কোনো পার্থক্য নাই আদি পয়গাম্বার হযরত আদম থেকে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) পর্যন্ত সবাই হচ্ছেন সেই ঈমানের দাওয়াতের কাফেলার এক একজন সাথী এবং একই ঈমানের দাওয়াতের কাফেলার এক একজন সাথী এবং একই ঈমানের দাওয়াত কেয়ামত পর্যন্ত এখানে অব্যাহত থাকবে।
অপর কথায় আজকের মুসলিম উম্মাহ সব কয়জন নবী ও তাদের রেসালাতের সরাসরি উত্তরাধিকার এবং মানবীয় ইতিহাসের এই দীর্ঘ ভান্ডারে রক্ষিত সর্বোৎকৃষ্ট সম্পদের তারা আমানতদার। এই উম্মতের স্বাভাবিক দায়িত্ব হবে তারা আল্লাহ্র সেই একই দ্বীন এবং তার প্রদর্শিত একই জীবন ব্যবস্থাকে দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠিত করবে। ইতিহাসের সূত্র ধরে তারাই আজ আল্লাহ্র বাছাই করা উম্মতের মর্যাদা লাভ করেছে। কালের এ দীর্ঘ পস্পরায় আজ তাদের সেই মূল সূত্রের দিক ধাবিত হতে হবে। তাদের কর্তব্য হচ্ছে তারা আধুনিক জাহেলিয়াতের সব সব কয়টি পোশাক- জাতীয়তাবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ, গোত্র ও বংশবাদ, ইহুদীবাদ খৃষ্টবাদ সাম্রাজ্যবাদ ও আল্লাহ্ কা‘আলার অস্তিত্ব অস্বীকারকারী আধুনিক মতবাদ সমূহেকÑ সমূলে বিনষ্ট করে শুধু ইসলামের এক ও একক পতাকা উচিয়ে ধরবে। দুনিয়ার বুকে গজে উঠা যাবতীয় জাহেলী ধ্যান ধারণা, জাহেলী সভ্যতা সংস্কৃতি, জাহেলী নাম পরিভাষা ও জাহেলী নীতি দর্শনের অপনোদন করে তারা শুধু আল্লাহ্র দ্বীনকে এসব কিছুর ওপর বিজয়ী করার সংগ্রামে আত্ম নিয়োগ করবে।
আল্লাহ্র ওপর ঈমান আনার এই পবিত্র উত্তরাধিকারÑ যার সংরক্ষক বানানো হয়েছে মুসলিম উম্মাতকেÑ মানবতার জন্যে এক মহামূল্যবান সম্পদ। মানবতার পথ প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও এটি হচ্ছে এক আলোক বর্তিকা। আল্লাহ্ তা‘আলাকে চেনা ও তার প্রতি একনিষ্ঠভাবে ঈমান আনার ক্ষেত্রেও এই উত্তরাধিকার হচ্ছে এক মূল্যবান সম্পদ তুল্য।
মানুষের অন্তর যখন ঈমান থেকে খালি হয়ে যায় তখন তার অন্তরাত্মা অন্ধকার হয়ে পড়ে, তার প্রকৃতি তখন বিভ্রান্ত ও দিক বেদিক হয়ে যায়, তার মনে তখন নানা ধরনের সন্দেহ শোবা দানা বাঁধতে শুরু করে, দুভাগ্য ও দুঃখ তাকে ঘিরে ফেলে, এভাবেই সে তখন অন্ধকারে হাতড়ে মরতে থাকে কিছুই সে দেখতে পায় না।
যাদের অন্তরে আজো জীবনের কিছু অবশিষ্ট অংশ মজুত রয়েছে তাা ঈমানের এই বাঞ্চানার ফলে চিন্তা বেদনায় কাতর হয়ে পড়ে, ইতিহাসের সব স্তরেই এদের অন্তরের এই আর্তনাদ শুনতে পাওয়া যায়। আর তাদের কথা আলাদা যাদের অন্তরে সে জীবনের মৃতুহয়ে যায়, তারা সবাই দলে দলে জন্তু জানোয়ারদের কাতারে শামিল হয়ে যায়। এরা জানোয়ারদের মতো খেয়ে দেয়ে আনন্দ ফূর্তি করে আল্লাহ্র জমিনে বিশৃংঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়Ñ এভাবেই এরা সয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা ও তার গোটা সৃষ্টি জগতের অভিশাপের কবলে নিপতিত হয়। সে সমাজ ঈমানের এই মহামূল্যবান সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়ে গেছে তা সত্যিকার অর্থে একটি হতভাগ্য ও নিকৃষ্ট মানের সমাজ ছাড়া আর কিছুই নয়, বৈষয়িক উন্নতির দিক থেকে তাকে যতোই সমৃদ্ধশালী মনে হোকনা কেন, মূলত ঈমানের মূল্যবান নেয়ামত ছাড়া তার কোনোই মূল্য নাই, ঈমান থেকে বঞ্চিত জাতি সমূহ হামেশা নৈরাশ্য ও অশান্তির আগুনে জ্বলতে থাকে। না পাওয়ার আক্ষেপ ও মানসিক সামাজিক পেরেশানী থেকে এরা কখনো মুক্তি পায় না সর্বদাই এরা শিকার থাকে এক সর্বগ্রাহী অসহায়তার। আজ সারা দুনিয়ার তথাকথিত উন্নত ও সম্পদশালী জাতি সমূহের দিকে তাকালে সহজেই এর সত্যতা অনুভব করা যাবে।
অপর দিকে আল্লাহ্ তা‘আলা তার ফেরেস্তা, তার কেতাব সমূহ ও তার রাসূলের ওপর যারা ঈমান আনে তারা সর্বদাই আল্লাহ্ তা‘আলার আনুগত্যের দিকে স্বস্তির সাথে নিবিষ্ট থাকে, তাদের একার ওপর পূর্ণাংগ ঈমান থাকে যে, একদিন সব কিছুর শেষে তাদের আল্লাহ্ তা‘আলার সামনেই হাযীর হতে হবে, আর এ কারণেই তারা তাদের গুনাহ খাতার জন্যে আল্লাহ্ তা‘আলার কাছেই ক্ষমা প্রার্থনা করে।
এবং তারা বলে, হে মালিক! আমরা তোমার কথা শুনেছি এবং তা কবুল করে নিয়েছি, হে আমাদের মালিক, আমরাতো শুধু তোমার ক্ষমাই চাই, আমাদের তো তোমার কাছেই ফিরে যেতে হবে। মু’মীনদের পক্ষ থেকে উচ্চারিত এসব কথায় তাদের আল্লাহ্র উপর ঈমান আনার বিষয়টি পরিস্ফূট দেখতে পাওয়া যায়, মু’মীন আল্লাহ্ হুকুম আহকাম শুনে এবং তা মেনে চলার মহান কাজে লেগে যায়, সে জানে আল্লাহ্ তা‘আলাই একমাত্র ও একক সার্বভৌম ক্ষমতা মালিক, তার বিধি বিধানের প্রতি পালন এবং নিজেদের জীবনে তার শরিয়তের প্রতিষ্ঠার নামই হলো ইসলাম। একজন মু’মীন জীবনের কোনো বড়ো কিংবা ছোট ব্যাপারেও যদি আল্লাহ্র এ হুকুমের প্রতিষ্ঠা না করে, হোক তা নীতি নৈতিকতা সম্পর্কিত কোনো ব্যাপারে কিংবা রাজনীতি ও অর্থনীতির কোন ব্যাপার যদি আল্লাহ্র আইনের বাইরে এসব কিছুর জন্যে সে অন্য কোনো উ॥সের সন্ধান করে তাহলে তার ঈমান আর অবশিষ্ট থাকতে পারে না, ঈমান তো হচ্ছে তা যা অন্তরে স্থান করে নিয়েছে এবং সে নিজের কাজ দিয়ে তার স্বীকৃতি প্রদান করে। এই শোনা ও মানার সাথে সাথে মু’মীন তার নিজের ভুল ভ্রান্তি সমূহের ব্যাপরেও সদা সজাগ এবং তার এই অনুভূতিও থাকে যে, আল্লাহ্র নেয়ামতের যে ধরনের কৃতজ্ঞতা তার আদায় করা উচিৎ ছিলো- তা সে করতে পারেনি তাই সে এখন আল্লাহ্র কাছেই প্রার্থনা করছে যেন আল্লাহ্ তা‘আলা তার ভুল ত্র“টি ক্ষমা করে দেন। এবং তার দুর্বলতার ব্যাপারে তার উপর যেন তিনি অনুগ্রহ করেন। ‘হে আল্লাহ্ আমরা তোমারই ক্ষমা প্রার্থনা করি।’
সর্ব প্রর্থম সারা জাহানের মালিকের দরবারে আনুগত্যের মাথা নত করা, তারপর তার বিধি নিষেধ শোনা এবং মানা ‘আবার ভুল ত্র“টি জন্যে তারই কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা সাথে সাথে এই বিশ্বাস পোষণ করা যে সব কিছুর শেষে তার কাছেই ফিরে যেতে হবে, দুনিয়া আখেরাতের চূড়ান্ত লক্ষ্য বিন্দু হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার অমোঘ সত্বা, সব কাজের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আল স্বয়ং নিজে তার একক সত্বা ছাড়া আশ্রয়ের দ্বিতীয় কোনো জায়গা নেই, তার বিচার ফায়সালা থেকে বাঁচারও কোনো উপায় নেই, না তার অমোঘ শাস্তি থেকে বাচা কোনো উপায় আছে, হাঁ এসব কিছুর একমাত্র উপায় হচেছ আল্লাহ্ তাবারাক তা‘আলার অশেষ দয়া ও ক্ষমা।
‘শুধু তোমার কাছেই ফিরে যেতে হবে’
একথটার মাঝে পরকালের ওপর ঈমান আনার বিষয়ের স্বীকৃতি রয়েছে। আর এই স্বীকৃতি হচ্ছে ঈমানের এক অপরিহার্য ও মৌলিক দাবীসমূহের অন্তর্ভূক্ত। এই ঈমানের মূল বক্তব্য হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষ্য জাতিকে এ দুনিয়ায় এজন্যেই সৃষ্টি করেছেন যেন তারা এখানে তার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে এবং তার এই বৈষয়িক জীবনের প্রতিটি কাজকর্ম হবে সেই চুক্তির ভিত্তিতে যা তাকে প্রতিনিধি নিয়োগ করার ব্যাপারে তার সাথে সম্পাদন করা হয়েছিল। এই চুক্তির শর্তাবলী যতোটুকু সে মেনে চলেছে পরকালে ততোটুকু পরিমাণ তার কাছ থেকে হিসাব নিকাশ গ্রহণ করা হবে এবং সে মোতাবেক তাকে পুরস্কার কিংবা শাস্তি দেয়া বে। মোট কথা হচ্ছে আখেরাত বিশ্বাসটি ইসলামের একটি মৌলিক চিন্তা বিশ্বাসের অন্তর্ভূক্ত এবং আখেরাত দিবসের এই ধারণার মাধ্যমে মু’মীন হৃদয়ে চিন্তাধারা পরিবর্তন এবং তার ফলে তার নিজরে জীবনে এক মৌলিক বিপ্লব সাধিত হয়। একজন মু’মীন ব্যক্তি আখেরাত বিশ্বাসের পর আল্লাহ্ তা‘আলার আনুগত্যের পথ ধরে চলতে থাকে, হামেশা ভালো কাজে তৎপর থাকে, নিজের যোগ্যতা ও প্রতিভাগুলোকে নেকী অর্জনের ওপর লাগিয়ে দেয়। তার এ কর্মতৎপরতায় তার এ দুনিয়ার বৈষয়য়িক কল্যাণ হোক কিংবা অকল্যাণ লাভ হোক কিংবা লোকসান হোক- সফলতা আসুক কিংবা ব্যর্থতা তার পথ রোধ করে দাঁড়াক, জীবনের পদে পদে সুখ সমৃদ্ধিও আসুক কিংবা আল্লাহ্র রাহে জীবন বিলিয়ে দেয়ার প্রয়োজন আসুক, সর্বাবস্থায় সে থাকে অনড়, কারণ তার জীবনের সব কিছুর বিনিময় সে শেষ বিচারের দিনেই পাবে, একারণেই সত্যের সংগ্রামে তার ওপর আপতিত বিপদ মুসীবত পরীক্ষা নিরীক্ষা- এর কোন কিছুই তাকে সত্যের সংগ্রামে সিপাহীদের পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনা। কারণ তার লেনদেন সবই আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে। সে তো তার মালিকের সাথে কৃত ওয়াদা ও চুক্তিপত্রের শর্তাবলী মানার কাজেই ব্যস্ত এবং একদিন জীবনের শেষে যখন তার কাছে হাযীর হবে তখন দুনিয়ার জীবনের কর্মকান্ডের একটি উকৎকৃষ্ট বিনিময় পাবার জন্যে অধির আগ্রহে সে অপেক্ষা করছে। আল্লাহ্ তা‘আলার ওপর, তার রাসূলদের ওপর তার ফেরেস্তাদের ওপর সর্বোপরি তার কেতাব সমূহের ওপর ঈমান আনার বিষয়টি এমনি এক অভিন্ন ঐক্য সূত্র যা একমাত্র ইসলামী ধ্যান ধারনারই একক বৈশিষ্ট্য। মূলত দুনিয়ার যাবতীয় ধর্ম মত ও বিশ্বাস সমূহের মাঝে একমাত্র ইসলামেরই এতোটুকু যোগ্যতা আছে যে, তা হবে মানুষের শেষ ধর্ম বিশ্বাস এবং যাবতীয় নবুওয়াত ও রেসালাতের মাজে তাই হবে শেষ রেসালাত।
কেননা ইসলাম ঈমানী কাফেলা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যতো নবী রাসূল এসেছেন যতো কেতাব তাদের উপর অবতীর্ণ হয়েছে তাদের সবার হেদায়াত ও শরীয়তের স্বীকার করে এবং পরিষ্কার করে একথা বলে দেয় যে, এই সব নবী রাসূলা একই তাওহীদের আকিদা ও বিশ্বাস নিয়ে দুনিয়ায় এসেছেন এবং মানবীয় উন্নতির ক্রমবিকাশের বিভিন্ন স্তরে এরা সবাই মানব জাতিকে একই পরিচিত শিক্ষা প্রদান করেছেন, মানুষের জন্যে একই ধরনের জীবন পদ্ধতি তারা পেশ করেছেন আর এরই নাম হচ্ছে ইসলাম।
ইসলাম মানুষকে ‘মানুষ’ হিসেবেই পেশ করেছে। ইসলাম মানুষের মর্যাদাকে জন্তু জানোয়ারের স্তরে নামিয়ে তাকে নিকৃষ্ট করে দেয়া আবার তাকে এতো উপরেও উঠিয়ে দেয় না যে, সে ফেরেস্তার স্তরে উন্নীত হয়ে যাবে ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ মানুষই, সে শয়তান নয় আবার ফেরেস্তাও নয়, তার মধ্যে যেমন বেশ কিছু শক্তি সামর্থ নিহিত রয়েছে আবার তাতেও কিছু দুর্বলতাও লুকায়িত আছে। তার যেমন রয়েছে জৈবিক প্রবণতায় ভরা একটি দেহ তেমনি রয়েছে অনুধাবনের জন্যে জ্ঞান বুদ্ধি ও উৎসাহ উদ্দীপনায় ভরা একটি নিবেদিত আত্মা।
এই কারণেই ইসলাম মানুষের ওপর ততোটুকু বোঝাই রাখে যতোটুকুর ভাব সইবার ক্ষমতা তার আছে ইসাম মানুষের যোগ্যতাও ও দাৈিত্বর মাঝে এক সুন্দর ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য সৃষ্টি করে, ইসলাম মানুষের জৈবিক প্রয়োজন জ্ঞানের দাবী পূরণ এবং আত্মার পরিতৃপ্তির মাঝে এক অপূর্ব সামঞ্জস্য সৃষ্টি করে তাকে এতোটুকু স্বাধীনতা দিয়ে দেয় যে সে যদি চায় তাহলে নিজেকে সত্যের পথে পরিচালিত করতে পারে আবার চাইলে নিজেকে বিভ্রান্তি ও গোমরাহীর চক্রাবালেও হারিয়ে দিতে পারে। আল্লাহ্ তা‘আলা কোনো ব্যক্তিকেই তার সামর্থের বাইরে কষ্ট দেন না, অতপর (এই পরীক্ষায়) যে ভালো কাজ করবে সে তার (ভালো) ফল পাবে আর যে অন্যায় করবে তার লোকসান তার ঘাড়েই পড়বে। আল্লাহ্ তাবারাক ও তা‘আলা মু’মীনদের ওপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য আরোপ করেছেন এবং দুনিয়ায় খেলাফত চালাবার জন্যে তার ওপর যে সব কাজ চাপিয়েছেন সে ব্যাপারে মু’মীনদের ধারণা হচ্ছে এর সবই হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলর পক্ষ থেকে আরোপিত মু’মীনদের জন্যে রহমত মাত্র এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তা‘আলা মু’মীনদের ওপর তার অনুগ্রহই প্রদান করেছেন এবং আল্লাহ্ তা‘আলা অত্যন্ত ইনসাফের সাথেই মানুষের ওপর এ দায়িত্ব দিয়েছেন, এ কারণেই মু’মীনরা হামেশাই আল্লাহ্ তা‘আলার রহমতের ওপর আস্থাশীল ও সন্তুষ্ট থাকে, এ সব দায়িত্ব পালনে কখনো তারা মনোক্ষুণœ হয় না। নিজেদের ওপর অর্পিত পবিত্র দায়িত্বকে তারা কখনো বোঝা মনে করে না। এর ফলে তাদের মনে কোনো সংকীর্ণতাও সৃষ্টি হয় না, বরং তার পূর্ণাংগ বিশ্বাস আছে যে, সে সব দায়িত্ব ও কর্তব্য তার ওপর দেয়া হয়েছে তা পালনের যথাযথ যোগ্যতা ও ক্ষমতা তার রয়েছে কেননা তা সম্পূর্ণতা তার যোগ্যতা ও সামর্থ অনুযায়ীই তাকে দেয়া হয়েছে, এই বিশ্বাস ও ধারণা মু’মীনদের হৃদয়ে এক অভূতপূর্ণ সাহস ও মনোবলের সৃষ্টি হয় যখনি কোনো সময়ে চলার পথ তার কাছে দীর্ঘ ও বন্ধুর মনে হয় তখন এই বিশ্বাস তার মধ্যে শক্তি যোগায় তাকে মনোবল দেয়। এই হচ্ছে মু’মীন হৃদয়ে প্রশীক্ষণ তার সাহস ও মনোবলের শক্তি। এর পর এই ধারণারই দ্বিতীয় দিক-ভালো কাজ করলে সে এর ভালো ফল ভোগ করবে। আবার মন্দ কাজ করলে তার ফলাফলও সেই পাবে।
এ হচ্ছে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত দায়িত্ব ও ব্যক্তিগতভাবে সে দায়িত্ব পালনের জবাবদিহী করার ধারণা যা কিছু ভালো হবে তা তার বক্তিগত কাজের বদলেই হবে। আর যা কিছু খারাপ হবে তাও হবে তার ব্যক্তিগত কর্ম কান্ডের ভুলের মাশুল। প্রতিটি মানুষ নিজের মালিকের সামনে নিজের একান্ত নিজের আমল নামা নিয়েই হাযীর হবে। সেখানে কেউ কারো সাহায্যকারী হবে না। প্রতিটি মানুষ আল্লাহ্র সামনে হবে একা, এই ধারণা ও বিশ্বাসের ফলে প্রতিটি মানুষকে এক একটি স্বতন্ত্র স্বত্মায় পরিণত হতে হয়। কোনো অবস্থায় কোনো ব্যক্তির পক্ষে আল্লহ্র অধিকার আদায়ে যেন কোনো ত্র“টি না দেখা দেয়। গোমরাহী পথভ্রষ্টতা বিদ্রোহ এবং বিশৃংখলা সৃষ্টির মোকাবেলায় আল্লাহ্র অধিকারকে যেন সে সংরক্ষণ করে কেননা প্রতিটি ব্যক্তিকেই আল্লাহ্ তা‘আলার অধিকার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে যে, সে আল্লাহ্র অধিকার কতোটুকু পালন করেছে তার আরোপিত নিষধাজ্ঞাসমূহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তার ইবাদাতে সদা মশগুল থেকেছে, সর্বোপরি নিজের চিন্তা ও কর্মে হামেশা আল্লাহ্র অনগত থেকেছে। যদি কোনো মানুষ অন্য কোনো মানুষের ধোকা ও লোভে পড়ে আল্লাহ্র ‘হক’ পালনে ত্র“টি করে তাহলে সে মানুষ কেয়ামতের দিন তাকে বাঁচাতে পারেব না। কেউই তার গুনাহর বোঝা সেদিন বইবে না, কেউই তার সাহায্য ও সহযোগিতার কাজে এগিয়ে আসবে না, এ জন্যেই প্রতিটি মানুষের উচিৎ তার নিজের প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসা এবং আল্লাহ্র যে সমস্ত ‘হক’ তার ওপর রয়েছে তার যথাযথ সংরক্ষণ করে, কেননা আল্লাহ্র আদালতে তার যাবতীয় কর্মকান্ডের জবাবদিহী তাকে একাই করতে হবে।
অপরদিকে এই ব্যক্তিগত দায়িত্বের অনুভূতির মানে এ নয় যে, ব্যক্তির ওপর সমষ্টির কোনোরকম কোনো দায় দায়িত্ব নাই। ব্যক্তিকে সমষ্টির পক্ষ থেকে আরোপিত দায়িত্বসমূহও আঞ্জাম দিতে হয়। কেননা স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলাই তাকে আদেশ দিয়েছেন যেন সে তার মাল সম্পদ রোজী রোজগার চেষ্টা সাধনা ও যাবতীয় ভাল কাজের মাধ্যমে সমষ্টির কল্যাণে এগিয়ে আসে এবং সামষ্টিকভাবে সত্যের পক্ষে কাজ করা ও অসত্যকে নির্মূল করার কাজে নিয়োজিত থাকাও তার জন্য জরুরী। যাবতীয় ভালো কাজকে প্রসারিত ও উৎসাহিত করবে এবং যাবতীয় মন্দ কাজকে নির্মুল ও নিরুৎসাহিত করবে, তার এ পর্যায়ের কাজগুলোও মহা বিচারর দিন তার আমলনামায় লিপিবদ্ধ করা হবে এবং তার কোনো কাজ সমষ্টির পক্ষে ক্ষতিকর ছিলো কিনা এই প্রশ্নও সেদিন তাকে করা হবে। একাই সেদিন তাকে এর জবাব দিতে হবে।
মুসলমানরা যখন এই সত্য সম্পর্কিত বিষয়টি শুনে নিলো এবং ভালো করে তা অনুধাবন করে নিলো এবার একান্ত বিনয় ও নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ্র কাছে তারা দোয়া চাইছে কুরআন এ দোয়ার কথাগুলোকে তার নিজস্ব স্টাইলে এমনভাবে পেশ করছে যেন কেথায়ও বুঝি এখকনি তা ঘটছে। ঘটনার বিবরণ দৃষ্টে মনে হয়, একদল নিষ্ঠাবান মু’মীন ব্যক্তি করজোড়ে বিশাল সম্রাজ্যের সম্রাটের সামনে হাত বেধে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সবার মুখে রয়েছে এই আকুতি- ‘হে আমাদের মালিক যদি আমাদের থেকে কোনো ভুল ত্র“টি হয়ে যায় অথবা কোনো দায়িত্ব পালনের কথা যদি আমরা ভুলে যাই তাহলে চাপিয়োনা যেমনি তুমি চাপিয়েছিলে আমাদের আগের লোকদের ওপর, হে মালিক যতোটুকু বোঝা বইবার ক্ষমতা আমাদের নাই সে পরিমাণ বোঝা আমাদের কাধে রেখোনো, তুমি আমাদের গুনাহ খাতা মাফ করে দিয়ে আমাদের ক্ষমা করে দিয়ো তুমি আমাদের ওপর দয়া করো। তুমিই আমাদের একমাত্র অভিভাবক, তুমি কাফেরদের ওপর আমাদের বিজয় দাও।
এই দোয়া মু’মীনদের মানসিক অবস্থার সঠিক বর্ণনা পেশ করে, দূর্বলতা ও বিনয়ের প্রকাশ করে, আল্লাহ্ তা‘আলার অসীম অনুগ্রহের পয়োজনীয়তার কথা বলে তার সাহায্য সহযোগিতার দরকারের বর্ণনা পেশ করে সর্বোপরি এতে বর্ণিত হয়েছে আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে মু’মীনের দুশ্চেদ্য বন্দনের কথা আল্লাহ্ তা‘আলার শত্র“দের মোকাবেলায় তাদের ওপর বিজয় লাভের জন্যে জেহাদের শক্তি এবং সাহায্য সহযোগিতার করুণ আরজী এতে বর্ণিত হয়েছে এবং সমগ্র দোয়ার কথাগুলোকে এমন এক হৃদয়গ্রাহী করে পেশ করা হয়েছে শুনে মনে হয় এক একটি শব্দ যেন আত্মার গভীরতম প্রদেশ থেকে উৎসারিত হচ্ছেঃ
‘হে আমাদের পরওয়ারদেগার তোমার কথা পালনে যদি আমরা ভুল করে বসি কিংবা আমরা যদি কোনো কিছু আদৌ ভুলে যাই তুমি আমাদের তার জন্যে পাকড়াও করো না।’
যদি কখনো কোনো মানবীয় দূর্বলতার কারণে মু’মীনের কোনো ভুল কিংবা পদঙ্খলন হয়ে যায়, তাহলে তা উপর দাঁড়িয়ে না থেকে টালবাহানা ও নানা অজুহাত খাড়া না করে সে সঠিক অবস্থা মেনে নেয়ার ও আনুগত্যের পথ অবলম্বন করে এবং আনুগত্য ও বিনয়ের পথ থেকে সরে এসে গোড়ামীর রাস্তা অবলম্বন করার বদলে মু’মীন এ ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে একান্ত বির্ণীত ভাবে নিজিরে ভুল ত্র“টির জন্যে ক্ষমার আরজী নিয়ে হাত উঠায়।
আল্লাহ্ তা‘আলা মু’মীনদের সাথে তাদের ভুল ত্র“টি মাফ করে দেওয়া ওয়াদা করেছেন, রাসূলে করীম (সা) হাদীসে বলেছেনঃ আমার উম্মাতের ভুলত্র“টি এবং যে সব গহির্ত কাজে তাদের বাধ্য করা হতে তা সব আল্লাহ্ তা‘আলা মাফ করে দিয়েছেন। (তিবারানী)
‘হে আমাদের মালিক! আমাদের ওপর এ কোনো বোঝা তুমি চাপিয়োনা যেমনি বোঝা তুমি চাপিয়েছো আমাদের পূর্ববর্তী মানুষদের ওপর মুসলিম উম্মাতের পক্ষ থেকে উচ্চারিত এই দোয়া এই সত্যের দিকেই ইংগীত প্রদান করে যে, তারা সব কয়টি রেসালাত ও সব কয়জন নবীরই উত্তরাধীকার। তাকে আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআনের মাধ্যমে পূর্ববর্তী জাতি সমূহের কর্মকাণ্ড ও তাদের প্রতি নিপতিত আল্লাহ্র সিদ্ধান্তের ওপর তাদের গুনাহ ও বিদ্রোহের কি শাস্তি এসেছে তাও মুসলিম জাতি তার কাছে প্রেরিত কেতাবে দেখেছে। যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা ইহুদীদের ওপর কতিপয় পবিত্র জিনিষও হারাম কে দিয়েছেন সূরয়ে ‘আনয়ামে’ এর প্রসংগে এসেছে।
‘যরা ছিলো ইহুদী তাদের জন্যে নখ বিশিষ্ট সব পশু আমি হারাম করে দিয়েছিলাম তেমনি ভাবে আমি তাদের ওপর গরু ও ছাগলের চর্বিও হারাম করে দিয়েছিলাম।’ (আন‘আম ঃ ১৪৬)
অতপর যখন তারা বাছুরকে খোদা বানিয়ে খোদা দ্রোহীতার মতো জঘন্য অপরাধ করেছে তখন আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের হুকুম দিয়েছেন নিজেদের হত্যা করে ফেলতে- এই সূরার প্রথম দিকে এর বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। একইভাবে তাদের ওপর শনিবারের দিনকে হারাম করা হয়েছে, বলা হয়েছে এ দিন যেন তারা কোনো ব্যবসায় কিংবা শিকার না করে।
এ কারণেই মু’মীন আল্লাহ্র দরবারে প্রার্থনা করছে। হে আমাদের মালিক! আমাদের ওপর এমন কোনো বোঝা চাপিয়ে দিয়োনা যেমনি করে তুমি চাপিয়ে দিয়েছিলে আগের লোকদের ওপর।
অথচ মুসলিম জাতির তো ব্যাপারই আলাদা, আল্লাহ্ তা‘আলা স্বয়ং রাসূল (সা) পাঠিয়েছেন যেন তিনি মানুষের কাঁধ থেকে বোঝা নামিয়ে দেন এবং মানবতার পায়ে এর আগে যে সব বেড়ি পরিয়ে রাখা হয়েছিলো তার যেন সবটুকু তিনি ফেলে দেন।
এদিক থেকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা অত্যন্ত সহজ হালকা ও মানবীয় প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল স্বয়ং আল্লাহ্র রাসূলকে বলা হয়েছে ‘আমি তোমাকে সহজ পদ্ধতির সুযোগ দেবো।’ (সূরা আন‘আম ঃ ৮)
সব চাইতে ভারী যে বোঝা আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলিম জাতির ওপর থেকে সরিয়ে নিয়েছেন তা হচ্ছে মানুষের ওপর মানুষের গোলামীর শেকল, এই গোলামীর ধরন আবার থাকে বিভিন্ন। কোায়ও এই গোলামীর ধরন হচ্ছে, একজন কিংবা একদল মানুষ আরেক দল মানুষের জন্যে আইন তৈরী করে। এর আরেক ধরন হচ্ছে, মানুষকে কখনো দল, গোত্র বংশ কিংবা জাতির গোলাম বানিয়ে দেয়া হয়। আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলমান জাতিকে এই ধরনের সব গোলামীর জিঞ্জির খুলে ফেলে শুধু আল্লাহ্র এবাদাত আনুগত্য করতে আদেশ দিয়েছেন। তাকে আদেশ দেয়া হয়েছে যে, শুধু আল্লাহ্র আইনেরই আনুগত্য করবে। এই ভাবেই আল্লাহ্ তা‘আলা তার নবীর মাধ্যমে মুসলিম জাতি জ্ঞান, তার রুহ ও তার গোটা জীবনকে অন্য সব গোলামী থেকে পবিত্র করে দিয়েছেন।
একমাত্র আল্লাহ্র গোলামীই মানুষকে পৃথিবীর অন্য সব কয়টি গোলামী থেকে মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে, মানুষ আল্লাহ্র গোলামীর বন্ধনে এসে অত্যাচারী বাদশাহ ও স্বৈরাচারী শাসকের গোলামী থেকে মুক্তি লাভ করে একই অবস্থায় সমাজ নেতা ও পথভ্রষ্ট গনকদের গোলামী থেকেও মুক্তি লাভ করে। ভ্রান্ত চিন্তা ধারা, কুসংস্ককার ও সমাজের পচা ও অচল রসম রেওয়াজের কাছ থেকে আল্লাহ্র গোলামী তাকে মুক্ত করে দেয়, একবার আল্লাহ্র গোলামীর কোনো সুযোগ থাকে না, এক কথায় এক আল্লহ্র গোলামী স্বীকার করে নিলে মানুষকে দ্বারে দ্বারে বারবার গোলামীর জন্যে মাথা ঠেকাতে হয় না। ‘আমাদের ওপর বোঝা চাপিয়ে দিয়োনা’ কথাটার মাঝে এই চূড়ান্ত আযাদীর দিকেই ইংগীত করা হয়েছে, মু’মীনদের পক্ষ থেকে আরজী পেশ করা হচ্ছেঃ
‘হে মালিক! আমাদের ওপর তুমি ছাড়া অন্য কারো গোরামীর বোঝা চাপিয়ে দিয়োনা যেমনি করে আমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহ এই গোলামীতে নিমজ্জিত ছিলো।’
‘হে আল্লাহ্! যে পরিমাণ বোঝা বইবার শক্তি সামর্থ আমাদের নাই সেই পরিমাণ বোঝা আমাদের ওপর রেখোনা।’
মু’মীন ব্যক্তি আল্লাহ্র দরবারে দোয়া করে, হে আমাদের মালিক! আমাদের দূর্বলতার ব্যাপারে তুমি আমাদের ওপর দয়া করে সে সব কাজের দায়িত্ব আমাদের দিয়োনা, যেগুলো কার সামর্থ আমাদের নাই, আমাদের শক্তি সীমার ভেতরে যা আছে এবং যতোটুকু সে সীমার ভেতরে থাকবে তা আমরা পালন করবো। আমরা তোমা কতিপয় দুর্বল ও অক্ষম বান্দা, তোমার ক্ষমার প্রাথী তোমার কাছে আমাদের বিনীত নিবেদনঃ তুমি আমাদের সাথে দোয়া ও সহজ আরচণ করো। অতঃপর মু’মীন আবার নিজের দূর্বলতার কথা ব্যক্ত করে সাথে সাথে এটাও আশা করে যে, পরম দয়ালু আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের গুনাহ খাতার প্রভাব সমূহকে স্বীয় দয়া ও মেহেরবানী দিয়ে মুছে দেবেন।
‘হে আমাদের মালিক! আমাদের গুনাহ খাতা মাফ করে দাও আমাদের তুমি ক্ষমা করো এবং তুমি আমাদের ওপর দয়া কর।
এ পর্যায়ে একথা মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলার দয়া ক্ষমা ও অনুগ্রহই হচ্ছে এই পরীক্ষায় টিকে থাকার নিশ্চয়তা বিধানকারী বিষয় কোনো মানুষই আল্লাহ্র আনুগত্যের পূর্ণাঙ্গ হক আদায় করতে পারবে না তাই আল্লাহ্র দয়া ও অনুগ্রহের দাবীই হচ্ছে তিনি তার করুণা দিয়ে যেটুকু সে কতে পারলোনা তা ক্ষমা করে দেবেন।
হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত আছে রাসূল (সা) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউই নিজের আমল দিয়ে বেহেস্তে যেতে পারবে না, সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, হে রাসূলুল্লাহ্ আপনিও নন? তিনি বললেন, না আমিও নই। হাঁ যদি আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে তার দয়া দিয়ে ঢেকে দেন। (বেখারী)
মোট কথা, একজন খাটী মু’মীন বান্দার কর্তব্য হবে, সে নিজের শক্তি সামর্থ অনুযায়ী আল্লাহ্র হুকুম আহকাম পালনের চেষ্টা করতে থাকবে, তবে সাথে সাথেনিজের দূর্বলতা ও অক্ষমতার ব্যাপারেও সজাগ থাকবে এবং এ কারণেই আল্লাহ্ তা‘আলার কাছ থেকে এই আশা পোষণ করবে যে, তিনি ার অসীম দয়া দ্বারা তার দূর্বলতাসমূহকে ঢেকে দেবেন এবং তার গুনাহ খাতা মাফ করে দেবেন।
পরিশেষে নেক বান্দা আল্লাহ্র পথে জেহাদ কাজে ইসলামী জীবন বিধানের প্রতিষ্ঠা ও তার দ্বীনকে দুনিয়ার বুকে বিজয়ী করার সংগ্রামে আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে সাহায্য প্রত্যাশা করে মু’মীন তামাম জাহেলী শ্লাগান, জাহেলিয়াতের সব ধরনের রসম রেওয়াজ ও জাহেলী সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে মু’মীন শুধু আল্লাহ্র দ্বীনের ঝান্ডাই বুলান্দ করার কাজে এগিয়ে আসে এবং তার দ্বীনকে সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে বেরিয়ে পড়ে এবং সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে সে আবার মালিকের দুয়ারে দয়া ভিক্ষা করেঃ
‘তুমিই আমাদের অভিভাবক, তুমি আমাদের মালিত, তোমার দ্বীনকে যারা অস্বীকার করে সে সব কাফেরদের সাথে সংগ্রামে তুমি তাদের ওপর আমাদের বিজয়ী করো।
সূরা বাকার এই পরিশিষ্টটুকু হচ্ছে গোটা সূরায় বর্ণিত বক্তব্যের সারাংশ, যাবতীয় আকিদা বিশ্বাসের সার সংক্ষেপ অনেকটা মু’মীন চরিত্রের আয়না স্বরূপ। সর্ােপরি এটা হচ্ছে মালিকের সামনে সদা বিনয়ের সাথে দোয়া করতে থাকারও এক অমূল্য অনুশীলন।